অপারেশন থিয়েটারে শ্বাস রুদ্ধকর কয়েক ঘণ্টা

মেলানি এবং ডাগ প্রিচার্ড দম্পতি যখন প্রথমবার সন্তান নেন তখন তারা প্রসূতি কাজে দক্ষ একজন ডাক্তার খুঁজছিলেন। ভালো ডাক্তার তো অনেক আছে। কিন্তু তারা শুধু ভালো ডাক্তার চান না, তারা চান এমন একজন ডাক্তার যে সন্তান প্রসবকালে বিপদ হলে প্রয়োজনে মেলানি এবং তার সন্তানের জীবনের জন্য যুদ্ধ করবে। সন্তান নেয়ার পূর্বে সব দম্পতিই বোধহয় এই চিন্তাটা করেন। কিন্তু কয়জনে সত্যিকার অর্থে এই রকম ডাক্তার পান। মেলানি এবং তার স্বামী পেয়েছিলেন। তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছিল নিরাপদে।

দ্বিতীয়বার মেলানি যখন গর্ভবতী তখনও সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। মেডিকেল চেকআপে কোনো ঝামেলা নেই, মা এবং শিশু দুজনেই পুরোপুরি সুস্থ। এমনকি গর্ভধারণের ৩৯ সপ্তাহ পরে যখন মেলানির প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়, তখন তিনি স্বামীর সঙ্গে হেঁটে হেঁটে হাসপাতালে গেলেন। হাসপাতালের ডাক্তাররা মেলানির প্রসব যন্ত্রণা আরো বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে তারপর পানি ভাঙলেন।

কিন্তু এর পর থেকেই শুরু হলো বিপদ। কারণ মেলানির ফুসফুস, হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে কাজ করলেও হঠাৎ করে তার মাথা ঘুরাতে শুরু করলো, বমি ভাব হলো এবং একপর্যায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। রক্তচাপ কমতে কমতে হয়ে গেলো শূন্য, থেমে গেলো হৃদস্পন্দন। ডাক্তারদের কাছে তিনি তখন একজন মৃত মানুষ। এদিকে সন্তান তখনো গর্ভে, শিশুটির হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপও সেইসাথে দ্রুত কমতে শুরু করেছে।

মেলানি তখন ক্লিনিক্যালি ডেড অথচ সন্তান তার গর্ভে। ডাক্তাররা মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলেন। কিন্তু পর মুহূর্তেই তারা দ্রুত বেগে শুরু করলেন জরুরি সিজার অপারেশন।

অপারেশন থিয়েটারে যখন এই অবস্থা চলছে তখন মেলানির স্বামীর প্রার্থনা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। ডাগ তার স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। স্ত্রীর এই অবস্থায় তিনি ভয়ানক অসহায় বোধ করলেন। তিনি মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে যেটা বলেছিলেন সেটা অনেকটা এইরকম, ‘ঈশ্বর, আমি জানি তোমার একটা পরিকল্পনা আছে কিন্তু সেটা সহ্য করার মত ক্ষমতা আমার নেই। তুমি একটু দয়া কর।’

ডাগ তার পরিবার এবং বন্ধুদের কাছে মিনতি করলেন তারা যেন শুধু মেলানি এবং তার শিশুকন্যার জন্য প্রার্থনা করে। মজার বিষয় হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা যখন এই প্রার্থনার আবেদন করে তখন সেটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কারণ ওইদিন গুগল এবং টুইটারে মানুষ সর্বোচ্চ যে একশোটি বিষয়ে আলোচনা করেছে তার মধ্যে রয়েছে ডাগ প্রিচার্ড ও তার পরিবার অন্যতম। ১৫ ঘণ্টার মধ্যে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ প্রার্থনা করেছে ইন্টারনেটে।

সৌভাগ্যক্রমে ডাক্তারদের একটি দল মেলানির শিশুটিকে বাঁচাতে সক্ষম হলেন এবং অন্য আরেকটি দল মৃত মেলানিকে বাঁচিয়ে তুললেন। হাসপাতালের নার্স যখন ডাগকে তার সদ্যজাত শিশুর নাম জিজ্ঞাসা করলেন, উত্তরে ডাগ নাম বললেন, গ্যাব্রিয়েলা। বাইবেলের বর্ণিত একটি শিশুর নাম, যার অর্থ- ঈশ্বরের প্রিয়তম।

প্রার্থনাতে কি আসলেই কাজ হয়? প্রার্থনা করে কি কারো জীবন বাঁচানো সম্ভব? কোনো মানুষ যখন মারা যায় তখন কেউ না কেউ তো ঠিকই প্রার্থনা করে তার জন্য। মৃত্যুর সময় মানুষ নিজে যেমন প্রার্থনা করে, তেমনি তার প্রিয়জনেরাও করে। কিন্তু মানুষ ঠিকই মরে যায়। তবে পৃথিবীতে অলৌকিক ঘটনাও ঘটে।

কারণ মেলানি প্রিচার্ড ডাক্তারদের হিসাব মতে, প্রায় ১০ মিনিট মৃত অবস্থায় ছিলেন। ডাক্তাররা চারবার তার বুকে ডিফিব্রিলেটর (থেমে যাওয়া হৃদস্পন্দন চালু করার বৈদ্যুতিক যন্ত্র) ব্যবহার করেছেন এবং সেইসাথে ছিল ক্রমাগত বুকের উপর চাপ প্রয়োগ করে শ্বাস প্রশ্বাস চালু করার চেষ্টা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কাজ হচ্ছিল না। মেলানির পরিবারকে বলা হয়েছিল বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে। ঠিক এই সময় একজন ডাক্তার হঠাৎ আবিষ্কার করলেন খুব দুর্বল হৃদস্পন্দন। কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব? ডাক্তাররা আবারো হতবাক হয়ে গেলেন।

আসলে কী ঘটেছিল মেলানির? ডাক্তারদের ভাষায় তার যেটা হয়েছিল সেটা হচ্ছে, এমনিয়টিক ফ্লুয়িড এমবোলিজম। এটা খুবই বিরল একটি রোগ এবং নির্ণয় করাও কঠিন। এমনিয়টিক ফ্লুয়িড হচ্ছে গর্ভবতী অবস্থায় নারীদের জরায়ুর অভ্যন্তরীণ এক ধরনের তরল যার ভেতরে মানবশিশু বেড়ে ওঠে। প্রসবের আগে যে ওয়াটার ব্রেকিং বা পানি ভাঙে সেটা আসলে এই এমনিয়টিক ফ্লুয়িড। মেলানির পানি ভাঙার পরে এই ফ্লুয়িড গিয়ে মিশেছিল তার রক্তে এবং হৃৎপিণ্ডে গিয়ে হয়েছিল হার্ট অ্যাটাক। মেলানি বেঁচে গেলেও ডাক্তাররা ডাগকে বলেছিলেন, প্রায় ১০ মিনিট মস্তিষ্কে অক্সিজেন না যাওয়ায় মেলানিকে সম্ভবত বাকি জীবন মস্তিষ্কের সমস্যায় ভুগতে হবে।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ নয়- মেলানির শরীরে রক্ত সঞ্চালন তখন অতিরিক্ত কম। কারণ সিজার অপারেশনের সময় তার একটি ধমনী কেটে গিয়ে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল এবং শিরাগুলোতে রক্ত সঞ্চালন হচ্ছিল না। তার হৃৎপিণ্ড কাজ করছিল ক্ষমতার মাত্র ৫ শতাংশ, যেখানে বাঁচার জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে ৫৫-৬০ শতাংশ। শুধু তাই না, হার্ট অ্যাটাক হওয়ায় তার ফুসফুস পুরোপুরি অকেজো হয়ে গিয়েছিল। তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল বাতাস পাম্প করার মেশিন দিয়ে। সেই মুহূর্তে মেলানিকে বাঁচানোর জন্য ডাক্তারদের করতে হয়েছিল আরেকটি জটিল অস্ত্রোপচার।

অস্ত্রোপচার শুরুর আগে ডাক্তাররা আরেকটি কাজ করলেন। মেলানিকে তার সদ্যজাত শিশুর একটি ছবি দেখালেন যাতে তার ভেতর বেঁচে থাকার উদ্যম কাজ করে। তাতে কাজ হয়েছিল। কারণ মেলানি ছবি দেখে কেঁদে উঠলেন। অচেতন ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করার আগ পর্যন্ত মেলানির ভেতরে কাজ করছিল বেঁচে থাকার লড়াই, যদিও ডাক্তাররা জানতেন দ্বিতীয়বারের এই অপারেশানে মেলানির বাঁচার সম্ভবনা ক্ষীণ।

তবে শেষ পর্যন্ত অস্ত্রোপচার সফল হলো। মেলানি বেঁচে গেলেন। ২৪ ঘণ্টা পর থেকেই স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে শুরু করলেন। জ্ঞান ফেরার পর প্রথম কোলে তুলে নিলেন তার মেয়েকে। তার এই ভাবে সুস্থ হয়ে ওঠা দেখে গোটা হাসপাতালের লোকজন বিস্মিত হয়েছিল।

হাসপাতালে ৬ দিন থাকার পর মেলানি ঘরে ফিরে যায় এবং তারপর থেকে তিনি পুরোপুরি সুস্থ একজন মানুষ। এই ঘটনার এক বছর পরে মেলানি একটি বই লিখলেন। বইয়ের নাম ‘দ্যা ডে আই ডায়েড’। বইয়ের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘যদিও আমার কিছু মনে নেই কিন্তু প্রিয়জনদের মাঝে বেঁচে থাকতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ। যারা আমার জন্য প্রার্থনা করেছেন তাদেরকে কিছু বলার মতো ভাষা আমার নেই, শুধু বলতে চাই আপনাদের প্রার্থনা বিফলে যায়নি। আমি মৃত অবস্থায় প্রাণ ফিরে পেয়েছি।’

মূল লেখক: ক্রিসটিনা আয়রেস(লেখক, সাংবাদিক, দার্শনিক)



মন্তব্য চালু নেই