প্রত্যাশার বাংলাদেশ
রাশিদুল ইসলাম জুয়েল : আমার একটা স্বপ্ন আছে। বাংলাদেশকে নিয়ে ছোট্ট একটি স্বপ্ন। স্বপ্নটা ঘুমের ঘোরে দেখা নয়, বাস্তবতার আলোয় দেখা। আমি স্বপ্ন দেখি একটি স্বনির্ভর বাংলাদেশের।যেখানে না খেতে পেয়ে কোনো মানুষ মারা যাবেনা, শীতবস্ত্রের অভাবে কোনো বৃদ্ধ বৃদ্ধা শিশু-কিশোরকে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যেতে হবেনা। স্বপ্ন দেখি একটি সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশের। যেখনে গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিরীহ মানুষের প্রাণ দিতে হবেনা, কোনো সন্ত্রাসীর সন্ত্রাসের ভয়ে বাধ্য হয়ে তাকে ভোট দিতে হবেনা। যেখানে কোনো বিচারক এর উপর হামলা হবেনা, অন্যায় করে কোনো অপরাধী পার পেয়ে যাবে না। স্বপ্নটা একটা লোড শেডিং মুক্ত ডিজিটাল বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পুর্ন বাংলাদেশের, যেখানে ঘরে ঘরে পৌছে যাবে বিদ্যুত এর আলো। বিদ্যুত এর অভাবে থেমে যাবে না কোনো কল-কারখানা, বিঘ্নিত হবেনা কোনো শিক্ষার্থীর জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ন পরীক্ষার প্রস্তুতি।টেলিভিশনের মতই প্রতিটি ঘরে থাকবে কম্পিউটার।স্বপ্ন দেখি একটি যানজটমুক্ত দেশের, যেখানে মানুষকে তার কর্মস্থলে যেতে ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে আটকা পরে থাকতে হবে না।
দুর্নীতি চাই না দেশকে ভালবাসতে চাই। দুর্নীতির কবল গ্রাসে দেশ আজ পুঙ্গত্বের দিকে ধাবমান,অন্ধত্বের বেড়া জালে আজ আমরা অন্ধ। অর্থের লোভে সততাকে দিয়েছি বিসর্জন। তবুও জানি দেশের বুকে আজও বেঁচে আছে কিছু সততা পিপাশু ব্যক্তি,সততার জন্য চালিয়ে যাচ্ছে সংগ্রাম। আজ ডাকছি আমি তাদের,জাগ্রত হও জনতা। দেশকে পিছন থেকে টেনে আনতে সামনে এগিয়ে আসতে হবে তোমাদের। দেশকে ভালবেসে দেশের তরে নিজেকে দাও বিলিয়ে হয়তো তা ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ নয়, নয় তা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন।তবুও যারা দেশকে ভালবাসে দেশের জন্য কাঁদে যার মন সকলে এক হলে,নিশ্চয় দুর্নীতি নিধন হবে।পরিবহন, জন নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা দেখতে চাই পুলিশ,শিক্ষক ও ডাক্তারদের কসাই নয় বরং সেবকের ভূমিকায় দেখতে চাই।যে সমাজে শিক্ষক অসত্য বলেন, চিকিৎসকরা মারামারি করেন, পুলিশ অপহরণ-হত্যা করেন, সাংবাদিকরা দলে-উপদলে বিভক্ত, পরিবার কর্তার অবৈধ আয় সন্তানের সামনে দৃশ্যমান- সেই দেশে মূল্যবোধের অবক্ষয়ই তো স্বাভাবিক বিষয়। কারণ নিয়ে আমরা কথা বলি না, চিন্তা করি না। চিৎকার করি ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’ নিয়ে। অবক্ষয় কেন হয়েছে বা হচ্ছে, তা অনুসন্ধান করি না, যদিও তা দৃশ্যমান। প্রতিকারে কোনও ভূমিকাও রাখি না।”উন্নয়ন” নিয়ে চিৎকার করি, ৬৬% কর্মক্ষম জনসংখ্যা নিয়ে গর্ব করি। অথচ এক কোটিরও বেশি শিক্ষিত তরুণ নিষ্ক্রিয়। তাদের সামনে কোনও কাজ নেই, স্বপ্ন নেই। আমরা ভাবিনা ভবিষ্যতের ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা।
বিজয়ের ৪৫ বছরে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি ওই সময় দেশ যেভাবে এগোনোর কথা,সেভাবে এগোতে পারেনি। এর জন্য রাজনৈতিক অনৈক্য, দেশপ্রেমের অভাবই দায়ী। তবে প্রাপ্তি একেবারে কমও নয়। অনেক ক্ষেত্রেই বড় সাফল্য আছে আরও আসতে পারত।ভবিষ্যতে দুর্নীতি, ক্ষুধা,দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চাই। এজন্য প্রত্যাশা করেছি রাজনৈতিক ঐক্য।
বিজয়ের ৪৫ বছর পার হয়েছে, সে সময় বাংলাদেশের যে অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। ওই সময় দেশটি আরও এগিয়ে যেতে পারত। ঘন ঘন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, রাজনৈতিক অস্থিরতা,সামরিক শাসনসহ নানাবিধ নৈরাজ্যকর শাসনের কারণে দেশ এগোতে পারেনি। দেশটি সঠিক গতিতে এগোলে এত দিনে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে পারতাম। দরিদ্রতা কমত, বেকারত্ব থাকত না, জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন হতো,ধনী-দরিদ্রের এত বৈষম্য থাকত না। বাংলাদেশের পরে স্বাধীনতা লাভ করে ভিয়েতনাম আমাদের চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা পারছি না। এজন্য আমাদের নেতৃত্বের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে দেশকে নিয়ে সবার ভাবতে হবে।
বাংলাদেশের একটি ভালো প্লাটফরম আছে। যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান ধারা বহাল থাকে তাহলে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ চিরকালই বাংলার মাটি ও মানুষের দেশ হয়ে থাকুক সেটাই আমরা চাই। সব ধর্মের, সব জাতের মানুষ মিলেমিশে দেশটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু গত সময়ে সব ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। এতে আমরা আহত হয়েছি। তবে অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে, অনেক অর্জন রয়েছে আমাদের। এগুলোর কারণে যেমন গর্ববোধ করি, তেমনি অপ্রাপ্তিও কম নয়। নারীর ক্ষমতায়ন,দারিদ্র্য নিরসন, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন হয়েছে বেশ। কিন্তু দুর্নীতি, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি, কুসংস্কার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখনো অনেক বড় একটি প্রতিবন্ধক। দুর্নীতির কলুষমুক্ত, সুশাসনের ছড়াছড়ি, হিংসা ও হানাহানিমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চাই।
আমরা ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেলেও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এখনো অর্জন করতে পারিনি।অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। অবকাঠামো উন্নয়নে এখনো অনেক পিছিয়ে দেশ। দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। রাজনৈতিক হানাহানি এখনো রয়েই গেছে। তিনি মনে করেন, এখন পর্যন্ত দেশের যে উন্নয়ন হয়েছে তার পেছনে প্রধান কারিগরি হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষ। তারা যেদিন সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করতে পারবেন, সেদিনই সত্যিকারের বিজয় আসবে। আমরা দুর্নীতিমুক্ত, শোষণমুক্ত, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। এই দেশ গড়তে তরুণদেরই এগিয়ে আসতে হবে। সে লক্ষ্যেই তরুণরা কাজ করছে। এখন অগ্রজদের উচিত তরুণদের সুযোগ করে দেওয়া।
স্বাধীনতার পর দেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল যুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী আধুনিক বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলা। সব ক্ষেত্রে সাফল্য না এলেও বাংলাদেশ আজ অনেক কিছুতে পরিকল্পিত ও গঠনমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে গর্বের সঙ্গে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তার পরও অনেক সীমাবদ্ধতা এখনো রয়ে গেছে তা কাটিয়ে উঠতে হবে। তাহলেই স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য অর্জিত হবে। আমি সবার আগে নিজেকে একজন গর্বিত বাঙালি হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি। এর মাধ্যমে আমরা উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই। যেখানে থাকবে না কোনো বঞ্চনা,দারিদ্র্য, সুশাসনের অভাব। একটি শিশুও থাকবে না শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে উঠবে আরও নিরাপদভাবে।
প্রত্যাশা ছিল অনেক অর্থনৈতিকভাবেও দেশ অনেক দূর এগিয়েছে। এখন আর তলাবিহীন ঝুড়িতে নেই দেশ। তবে প্রত্যাশা আরও অনেক বেশি ছিল। ৪৫ বছরে বিভিন্ন দেশের অগ্রগতি অনেক। সে তুলনায় অগ্রগতি তেমনটা হয়নি। এর পেছনে বড় কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক অনৈক্য। মুক্তিযোদ্ধের যে চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সেটি এখনো অর্জিত হয়নি। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই,যেখানে আমরা মাথা উঁচু করে বিশ্বে দাঁড়াতে পারব। গর্ব করে বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করতে পারব।
সেই দেশ গড়তে হলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। নীতিনির্ধারকদের আরও দেশপ্রেমিক হতে হবে। দুর্নীতি উচ্ছেদ করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্নীতি মুক্ত করে এবং শিক্ষাঙ্গনে সুশাসন কায়েম করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী চেতনা জাগিয়ে তোলা সম্ভব।
গত ৪৫ বছরে দেশটা যেখানে দেখতে চেয়েছিলাম, সেখানে এখনো পৌঁছতে পারেনি। এত কষ্ট ও রক্তের বিনিময়ে অর্জন করা এ দেশটাকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার বাস্তবায়ন হয়নি। সবচেয়ে বড় কষ্টের বিষয়, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান অনেক মুক্তিযোদ্ধা এখনো অসহায়। অসহায় যুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্র থেকে ভরন-পোষণ করা উচিত। কিন্তু সেগুলোর প্রতিফলন রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমরা দেখতে পারছি না। প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশ এগিয়ে না যাওয়ার পেছনে বড় কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক অনৈক্য ও দেশপ্রেমের অভাব। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে এখনো দেশপ্রেম জিম্মি হয়ে ওঠে। ফলে দেশের স্বার্থ প্রাধ্যান্য পায় না। এসব দেখে মাঝে মধ্যে হতাশ হয়ে পড়ি। তবে এত হতাশার মাঝেও দেশটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভুলিনি। এ দেশের অর্জন হয়তো সেভাবে হয়নি, যেভাবে চেয়েছিলাম। তবে অর্জনের ভান্ডার যে খালি তাও নয়। সবার আগে চাই দেশটা দুর্নীতিমুক্ত হোক। অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হোক। আমরা আর ভিক্ষা করে চলতে চাই না। বিদেশের সাহায্য চাই না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।
লেখকঃ রাশিদুল ইসলাম জুয়েল
সিঙ্গাপুর প্রবাসী কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
মন্তব্য চালু নেই