ফজলে হাসান আবেদের বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার গ্রহণ
‘দরিদ্র লোকেরাই আমাদের নায়ক’
দূর থেকেই শোনা যাচ্ছে ট্রাম্পেট, স্যাক্সোফোন আর ড্রামের সম্মিলিত বাজনার আনন্দধ্বনি। শহরের মোড়ে মোড়ে পতপত করে উড়ছে ঝলমলে ব্যানার। বিকেলের সোনালি আভায় স্টেট ক্যাপিটল ভবনটা যেন জ্বলছে। ভবনের গা বেয়ে নেমে এসেছে বিশাল বিশাল ফেস্টুন।
গাড়ি থেকে নেমে ভবনের প্রবেশপথে লালগালিচায় যখন পা রাখলেন এ বছরের ‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ’ বিজয়ী স্যার ফজলে হাসান আবেদ, তখন কলেজপড়ুয়া বাদক দলের বাজনা যেন উন্মত্ততার পর্যায়ে; আইওয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী দে ময়েনের আকাশে-বাতাসে তীব্র গতিতে ছুটে বেড়াচ্ছে হাজারো আনন্দের রেণু। এর পরিসমাপ্তি হলো ১৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজের চেয়ারম্যান তৃতীয় জন রুয়ানের স্যার ফজলে হাসান আবেদের হাতে সম্মানজনক এ পুরস্কার তুলে দেওয়ার মাধ্যমে। শতাধিক বরেণ্য বিজ্ঞানী, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর উপস্থিতিতে সম্মানিত হন বাংলাদেশের এই কৃতী উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ বিতরণের দিনটির জন্য দে ময়েন শহর অপেক্ষা করে থাকে পুরো বছর। দিনটি আইওয়াবাসীর জন্য বড্ড আনন্দ আর গর্বের। কারণ, এ পুরস্কারের প্রবর্তক নোবেলজয়ী নরম্যান বোরলগ দে ময়েন শহরেরই সন্তান।
খাদ্য ও কৃষি খাতের নোবেল সমতুল্য আড়াই লাখ ডলার অর্থমূল্যের এবারের পুরস্কারের ঘোষণাটা এসেছিল এ বছরের জুলাই মাসের শুরুতেই। জানিয়ে দেওয়া হয়, এবারের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ পুরস্কার বাংলাদেশ এবং বিশ্বের আরও ১০টি দেশে ক্ষুধামুক্তির আন্দোলনে অসামান্য অবদানের জন্য তুলে দেওয়া হবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের হাতে। আর তাই ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘এ পুরস্কার আসলে আমার একার না, এ পুরস্কার ব্র্যাকের গত ৪৩ বছরের কাজের স্বীকৃতি। যে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা মিলে বাংলাদেশ, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোয় লাখ লাখ মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের পথ দেখিয়েছে বিগত দিনগুলোয়।’
ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘আমাদের নায়ক আসলে দরিদ্র লোকেরাই, বিশেষত দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা সেই নারী, যাঁরা জীবনের প্রতিটি পদে বাধার সম্মুখীন হন এবং তা কাটিয়ে ওঠেন। কারণ, একজন নারী যেভাবেই হোক না কেন, তিনি তাঁর পরিবারের জন্য খাদ্য জোগাড় করতে পারেন।’
বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার তুলে দেওয়া উপলক্ষে ফুড প্রাইজ কমিটি প্রতিবছর আয়োজন করে সাত দিনব্যাপী এক জমকালো আয়োজনের। যেখানে উপস্থিত হয়েছেন খাদ্য নিয়ে কাজ করা বিশ্বের বড় বড় ব্যক্তিরা। কথা বলেছেন দারিদ্র্য বিমোচনে নানা করণীয় নিয়ে। আর এই পুরস্কার বিতরণী উৎসবের শেষটা হচ্ছে পুরস্কার বিতরণী ও ‘বোরলগ ডায়ালগ’ নামে খাদ্য উৎপাদন, মানোন্নয়ন, বণ্টন, নতুন আবিষ্কার ইত্যাদি নিয়ে অনেক আলোচনা ও মতবিনিময় সভার মাধ্যমে।
বোরলগ ডায়ালগে ফজলে হাসান আবেদ বলেন তাঁর গল্প। একাত্তর-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বিপর্যস্ত মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে আরামের করপোরেট চাকরি ছেড়ে ১৯৭২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ব্র্যাক। সে প্রতিষ্ঠানই দিনে দিনে এত বড় হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের সাড়ে ১৩ কোটি মানুষ ব্র্যাকের সেবার আওতাভুক্ত। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর জন্য সব পেশার মানুষই প্রয়োজন। তবে যারা পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে, তাদের উচিত উন্নয়ন খাতে আসা।
আইওয়া স্টেট ক্যাপিটল ভবনের হলরুমে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শুরু হয় একদম ঘড়ি ধরেই সন্ধ্যা সাতটায়। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট অ্যাম্বাসেডর কেনেথ এম কুইনের সাবলীল উপস্থাপনায় বক্তব্য দেন এ পুরস্কারের প্রবক্তা বোরলগের কন্যা জেনি বোরলগ, আইওয়া স্টেটের গভর্নর টেরি ব্র্যানস্টেডসহ অনেকেই। হলে উপস্থিত ছিলেন গত আটবার পুরস্কার বিজয়ীসহ যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিমন্ত্রী টম বিলস্যাক, মালাবির সাবেক প্রেসিডেন্ট জয়েস বান্দাসহ বেশ কয়েকজন। ছিলেন ফজলে হাসান আবেদের সহধর্মিণী সৈয়দা সারওয়াত আবেদও। সংগীতে চমকে দিতে আসেন বাংলাদেশের রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী শামা রহমান। তিনি দুটি গান গেয়ে শোনান।
স্যার আবেদকে পুরস্কৃত করার বিষয়ে পুরস্কার কমিটির প্রেসিডেন্ট কেনেথ কুইন বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা যখন ৯০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে, তখন ক্ষুধাপীড়িত মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এই চ্যালেঞ্জ সামনে রেখেই স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও তাঁর প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক নারীশিক্ষার বিস্তার, ক্ষমতায়ন এবং পুরো প্রজন্মকে দারিদ্র্যমুক্ত করার একটি অসাধারণ মডেল উদ্ভাবন করেছেন। এই অনন্য কীর্তির জন্য এ বছর তিনিই এই পুরস্কারের যোগ্য ব্যক্তি।’
খাদ্য ও কৃষিতে অসামান্য অবদানের জন্য নরম্যান বোরলগ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৭০ সালে। এরপর তিনি নোবেল কমিটিকে খাদ্য ও কৃষিবিজ্ঞানে অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন। সাড়া না পেয়ে ১৯৮৭ সালে নিজেই চালু করেন ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ। দিনে দিনে এ পুরস্কার এতই বড় হয়েছে যে এখন একেই বলা হয় খাদ্য ও কৃষির নোবেল পুরস্কার। এ পর্যন্ত বিশ্বের মানুষের খাদ্য সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য মোট ৪১ জন এ পুরস্কার পেয়েছেন। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ১৯৯৪ সালে এই সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ এর আগে বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে স্প্যানিশ অর্ডার অব সিভিল মেরিট, লিও টলস্টয় ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড মেডেল, গেটস অ্যাওয়ার্ড ফর গ্লোবাল হেলথ, ইনোগরাল ওয়াইজ প্রাইজ ফর এডুকেশন, ইনোগরাল ক্লিনটন গ্লোবাল সিটিজেন অ্যাওয়ার্ড, র্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড ফর কমিউনিটি লিডারশিপ। ২০০৯ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের নাইট উপাধি পান।
মন্তব্য চালু নেই