ক্রেস্ট জালিয়াতি নিয়ে ঘুমিয়ে দুদক

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বিদেশি বন্ধু ও সংগঠনকে দেওয়া সম্মাননার ক্রেস্টে সোনা কম দেওয়ার অভিযোগে সরকার গঠিত দুটি তদন্ত কমিটির রিপোর্টে প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী ও সচিবসহ বেশ কয়েকজনকে দায়ী করা হয়েছে।

অনুসন্ধানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার এক বছর পরও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান এখন গতিহীন। বরং অদৃশ্য কারণে অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করছে সংস্থাটি। এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে নথিপত্র সংগ্রহ করা ছাড়া অনুসন্ধানে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

২০১৪ সালের ৮ মে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত রিপোর্টে একই মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম, মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন সচিব মিজানুর রহমান, বর্তমান সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকীসহ ১৩ কর্মকর্তা ও দুই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা হয়।

অন্যদিকে চলতি বছরের ২৫ মে সংসদীয় কমিটির তদন্ত রিপোর্টেও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, যুগ্ম-সচিব মো. আবুল কাশেম তালুকদারসহ চার কর্মকর্তাকে দায়ী করে আইনানুগ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

এর পরও দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দুদকের কেন এই নীরবতা, তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মাঝে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

দুই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরও দুদকের তৎপরতা নেই কেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে দুদকের চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছি। অনুসন্ধানে সকল তদন্ত রিপোর্টই আমলে নেওয়া হবে। এখন সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।’

তিনি বলেন, ‘সংসদীয় কমিটি কী ব্যবস্থা নেয় সে বিষয়ও আমরা বিবেচনা করব। কমিটি চাইলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি মামলাও করতে পারি। তাই আমরা অপেক্ষা করছি।’

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, দুদক চাইলেই অভিযোগটি খতিয়ে দেখতে পারে। সেজন্য কোন কমিটি কী রিপোর্ট দিল তার ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। তবে সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট দুদকের অনুসন্ধানে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু স্বাধীন কমিশন হিসেবে দুদকের অন্যের তদন্তের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। কারণ দুদকের পর্যাপ্ত আইনি ক্ষমতা রয়েছে।

স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের অক্টোবরের মধ্যে এই সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল। তখন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন এ বি তাজুল ইসলাম।

মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনকে সম্মাননার সময় দেওয়া ক্রেস্টে যে পরিমাণ স্বর্ণ থাকার কথা ছিল, তা দেওয়া হয়নি। আর ক্রেস্টে রূপার বদলে দেওয়া হয় পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত সংকর ধাতু।

সূত্র আরো জানায়, জাতীয় মান সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরীক্ষায়ও জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে সূত্রটি জানায়।

সম্মাননা প্রদান-সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা আছে, প্রতিটি ক্রেস্টে এক ভরি (১৬ আনা) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রূপা থাকবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে করা বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এক ভরির (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) জায়গায় ক্রেস্টে স্বর্ণ পাওয়া গেছে মাত্র ২ দশমিক ৩৬৩ গ্রাম (সোয়া তিন আনা)। এক ভরির মধ্যে প্রায় ১২ আনাই নেই। আর রুপার বদলে ৩০ ভরি বা ৩৫১ গ্রাম পিতল, তামা ও দস্তা মিশ্রিত সংকর ধাতু পাওয়া গেছে।

ইতিমধ্যে এ বিষয়ে গঠিত সরকারের দুই তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও এই জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ৮ মে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কমিটির তদন্তে জালিয়াতির জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম, মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন সচিব মিজানুর রহমান, বর্তমান সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকীসহ ১৩ কর্মকর্তা ও দুই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা হয়। আরো যাদের দায়ী হয়েছে তারা হলেন ক্রেস্ট দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ও মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তফা, যুগ্ম-সচিব মো. আবুল কাসেম, উপসচিব এনামুল কাদের খান, জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মো. বাবুল মিঞা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ের নিরীক্ষক আনিসুর রহমান, সুপারিনটেনডেন্ট আমিনুর রশিদ, নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বেগম জেসমিন আক্তার, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বেগম জাহানারা পারভীন, সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান এবং সাঁট মুদ্রাক্ষরিক আবুল কাসেম৷

অন্যদিকে চলতি বছরের ২৫ মে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকীসহ চার কর্মকর্তাকে দায়ী করে আইনানুগ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংসদীয় তদন্ত কমিটি। অভিযুক্ত বাকি তিনজন হলেন- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মো. আবুল কাশেম তালুকদার, উপসচিব ও জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব এস এম এনামুল কবির এবং ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা (শাখা সহকারী) আবুল কাশেম।

তবে এ ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম এবং প্রাক্তন সচিব মিজানুর রহমানসহ বাকি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তাদের কারোরই এ ঘটনায় সম্পৃক্ততা পায়নি সংসদীয় তদন্ত কমিটি। এজন্য তাদের অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। সাংসদ ডা. মো. আফসারুল আমীনকে আহ্বায়ক করে সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্য হলেন সাংসদ ইকবালুর রহীম ও সাংসদ গোলাম দস্তগীর গাজী। তাদের দেওয়া প্রতিবেদনে চার দফা সুপারিশ, পর্যালোচনাসহ এ ঘটনার সঙ্গে যাদের যোগসূত্র ছিল তাদের জবানবন্দি রয়েছে।

সংসদ সদস্যদের দাবির মুখে ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রথম বৈঠকে ওই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে সরকার স্বাধীনতার চার দশক পূর্তি উপলক্ষে সাত পর্বে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু স্বনামধন্য ৩৩৮ বিদেশি ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে অন্যান্য উপহারসামগ্রীর সঙ্গে একটি করে ক্রেস্ট দেয়। তিন শ্রেণিতে এই সম্মাননা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা হিসেবে সবার হাতে একটি করে ক্রেস্ট তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এর মধ্যে স্বাধীনতা সম্মাননা পান একজন, ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী (মরণোত্তর)। ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়িসহ ১৩ বিশিষ্টজনকে দেওয়া হয় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা। বাকি সব ব্যক্তি ও সংগঠনকে দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা।

ইন্দিরা গান্ধীকে দেওয়া স্বাধীনতা সম্মাননা ক্রেস্টটি ২০০ ভরি স্বর্ণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এটিও সরবরাহ করে এমিকন নামের প্রতিষ্ঠানটি। ২৪ ক্যারেটের (বিশুদ্ধতার সূচক) স্বর্ণ দিয়ে এটি তৈরি করার কথা ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরমাণু শক্তি কমিশনে ওই ক্রেস্টটি পরীক্ষা করে দেখতে পায়, তাতে ১০ দশমিক ১১ ক্যারেট স্বর্ণ রয়েছে।

সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে একটি ক্রেস্টের জন্য অন্যান্য খরচের সঙ্গে দুই ভরির বেশি (২৩ দশমিক ৫ গ্রাম) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি (বিলে লেখা গ্রাম, কিন্তু দাম ভরির) রুপার দাম পরিশোধ করা হয়েছে। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান ছাড়া এই ক্রেস্ট কেনা হয়েছিল। ৩৩৮টির মধ্যে ৬০টি ছাড়া বাকি সব ক্রেস্ট সরবরাহ করেছে এমিকন।রাইজিংবিডি



মন্তব্য চালু নেই