শাড়ি-লুঙ্গির জাকাতে প্রাণহানি : ইসলাম কী বলে?
জাকাত। ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে যারা সম্পদশালী তাদের জন্য একটি অবশ্য পালনীয় (ফরজ) বিধান। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা তথা ধনীদের কাছে যাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত না থাকে এবং সমাজের গরিব শ্রেণীও যাতে দারিদ্র্যমুক্ত হয়, ক্ষুধা চিরতরে দূরীভূত হয় সেজন্যই এই বিধান দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। এই বিধান সংবলিত আয়াতই শুধু অবতীর্ণ করা হয়নি, কীভাবে এ জাকাত সংগ্রহ করা ও বণ্টন করতে তারও রয়েছে সুস্পষ্ট বিধান।
কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরেই আমাদের দেশে একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, রমজান মাস এলেই বিভিন্ন মার্কেটের সামনে ব্যানার-ফেসটুন সাঁটানো হয় যাতে লেখা থাকে ‘এখানে জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি পাওয়া যায়’।
শুধু তা-ই নয়, জাকাত দেয়া হবে বলে মাইকিংও করা হয়। ফলে ঘোষণা অনুযায়ী দরিদ্র মানুষেরা একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা জাকাত দাতার বাসা-বাড়িতে গিয়ে ভিড় করেন। অধিক সংখ্যক মানুষ একত্রিত হওয়ার ফলে এবং শৃঙ্খলা বিধানের জন্য যথেষ্ট পূর্ব প্রস্তুতি না থাকার কারণে হুড়োহুড়িতে প্রাণহানি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এ ফরজটি যেকোনো সময়ই আদায় করা যায়। কিন্তু রমজান মাসে যেকোনো ইবাদতের সওয়াব অন্য সময়ের তুলনায় ৭০ গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয় বলে জাকাতও এ মাসে আদায়ের প্রবণতা রয়েছে। এতে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু প্রতিবছর সওয়াব কামাইয়ের আয়োজন করতে গিয়ে এতো প্রাণহানি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
শুক্রবার এমনই এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে ময়মনসিংহের শহরের নূরানি জর্দা ফ্যাক্টরিতে। জাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে ঝরে গেছে ২৫টি তাজা প্রাণ। এদের মধ্যে ২২ জনই নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২০ জন।
কিন্তু ইসলামে জাকাত বণ্টনের বিধান কী? এ বিষয়টি অনেকেরই হয়তো জানা নেই। আর একারণেই ধনীদের মধ্যে এই প্রবণতাটা কমছে না।
জাকাত বণ্টনের ব্যাপারে কোরআনের স্পষ্ট ঘোষণা-
إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ [عَلِيمٌ حَكِيمٞ [التوبة : 60
অর্থাৎ, সাদাকাহ (জাকাত) তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও জাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এটি আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবা, আয়াত- ৬০)।
উল্লিখিত খাতেই জাকাত আদায় করতে হবে।
অন্যদিকে রাসূলের (সা.) বিভিন্ন হাদিস থেকে যাকাত গ্রহণ ও বণ্টনের সুস্পষ্ট পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়।
রাসূল (সা.) বলছেনে- تؤخذ من أغنيائهم فترد إلى فقرائهم
অর্থাৎ, তুমি তাদের ধনীদের থেকে যাকাত আদায় করবে অতঃপর তাদের গরিবদের মাঝে তা বিতরণ করবে। (বুখারি- ১৪০১)
এখানে যে বিষয়টি লক্ষ্য করা যায় তা হলো- জাকাত রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করতে হবে বিত্তবানদের কাছ থেকে এবং তা বণ্টন করতে হবে দরিদ্রদের মধ্যে।
এ নির্দেশনার অংশ হিসেবেই রাসূল (সা.) হযরত মু’আযকে (রা.) ইয়েমেনে পাঠিয়েছিলেন। সেখানকার বিত্তবান লোকদের থেকে জাকাত আদায় করে সেখানকার গরিবদের মধ্যে বিতরণ করার আদেশ দিয়েছিলেন।
এতে বুঝা যায়, যারা জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত তারা জাকাত দাতার কাছে গিয়ে গ্রহণ করবেন না বরং তাদের কাছে জাকাত পৌঁছে দিতে হবে। যেমনটি রাসূল (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন হযরত মু’আযকে (রা.)।
কিন্তু আমাদের দেশে যেহেতু জাকাত আদায় ও বণ্টনের কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নেই সেক্ষেত্রে রাসূলের (সা.) জাকাত বণ্টন বিষয়ক হাদিসেরই অনুসরণ করে জাকাত প্রাপ্তির উপযুক্তদের কাছে নিজ ব্যবস্থাপনায় জাকাত পৌঁছে দিতে হবে বলেই প্রতীয়মাণ হয়। জাকাতের কাপড় দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়ে দরিদ্র মানুষদের জড়ো করে জাকাত দেয়ার নির্দেশনা ইসলামের কোথাও নেই।
ইসলাম বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সত্যিকার অর্থে ইসলাম যে সুফলের জন্য যাকাত ফরয করেছে তা পেতে হলে জাকাত আদায়ের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী এর কয়েকটি দিক নিচে তুলে ধরা হলো:
১. যাকাত আদায় করবে মুলতঃ রাষ্ট্র বা সরকার। দেশের সরকার সংসদে আইন পাস করে আয়কর আদায়ের মতো বাধ্যতামূলকভাবে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকদের জন্য জাকাত বাধ্যতামূলক করে দেবে। সূরা তওবাতে আল্লাহ সেদিকে ইঙ্গিত করে বলেন- : خَذُ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تَطَهِّرُهُمْ وَتُزْكِّهِمْ
তাদের ধন-সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করে তাদের পবত্রি এবং পরচ্ছিন্ন করে দাও। (সূরা তওবা, আয়াত ১০৩)
অন্যদিকে রাসূল (স.) বলছেনে- تؤخذ من أغنيائهم فترد إلى فقرائهم
তুমি তাদের ধনীদের থেকে যাকাত আদায় অত:পর তাদের গরীবদের মাঝে তা বিতরণ করবে। (বুখারি- ১৪০১)।
জাকাত সংগ্রহের পর সরকার যদি ১০/১৫ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে এগুতে থাকে তাহলে দারিদ্র্য বিমোচন বাংলাদেশের ধনীদের টাকা দিয়েই সম্ভব। বিদেশ নির্ভরতার প্রয়োজন হবে না।
২. জাকাত আদায়ের দ্বিতীয় যে দিকটি বাস্তবায়িত হওয়া উচিৎ তা হলো, ব্যক্তিগত পর্যায়ে জাকাত দিলেও একজন অভাবীকে এতটুকু পরিমাণ জাকাত দেয়া উচিৎ যাতে তার বর্তমান সমস্যার সমাধান হয়। একইসঙ্গে তিনি তার ভবিষ্যৎ চলার একটি পথ বের করতে পারবেন।
দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্র থেকে তাকে বের হওয়ার মতো জাকাত দিতে হবে। যেমন: একজন বেকারকে একটি তরকারির দোকান অথবা চাইলে রিকশা কেনার মতো অর্থ দেয়া ইত্যাদি। প্রচলিত শাড়ি আর লুঙ্গি দেয়ার প্রবণতা কমিয়ে আনতে হবে।
৩. জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে লোক দেখানো ও নির্বাচনী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসা। কারণ, লোক দেখানো ইবাদত হলো ‘রিয়া’। আর রিয়া ইসলামের দৃষ্টিতে শিরক। অতএব ইবাদত করতে গিয়ে যদি শিরক হয় তাহলে সব আমল বরবাদ হয়ে যাবে।
৪. জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা উচিৎ সমাজের দারিদ্রপীড়িত ঐসব মানুষকে যারা টাকার অভাবে লেখাপড়া করতে পারে না। জাকাত সহায়তা পেয়ে একটি ছেলে/মেয়ে শিক্ষিত হয়ে বেড়ে উঠলে তার আলোয় সমাজ আলোকিত হবে, আলোকিত হবে দেশ।
এ প্রসঙ্গে সুরা বাকারার ২৬৪নং আয়াতে এসেছে- আল্লাহ তায়ালার হুকুম পালন ও তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই জাকাত দিতে হবে। জনসমর্থন অর্জন, লোকদের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য কিংবা অন্য কোনো জাগতিক উদ্দেশ্যে জাকাত দেয়া হলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না।
মন্তব্য চালু নেই