পারিবারিক কলহে কেন ঘটছে হত্যাকাণ্ড?

১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসের রাত। স্বামী প্রহলাদ চন্দ্র দে’র সাথে প্রতিদিনের মত একই রুমে ঘুমাতে যান সীমা মিত্র। রাত আনুমানিক ১টার দিকে হঠাৎ সীমার আর্ত চিৎকারে জেগে ওঠে পাশের বাড়ির কয়েকজন। দেয়াল টপকে প্রবেশ করে বাড়ির ভেতর।

সীমাকে তারা ঘরের মধ্যে আবিষ্কার করে আগুনে জ্বলন্ত অবস্থায়। স্বামী প্রহলাদ তখনো বাড়িতে আছেন তবে তার শরীরে আগুনের কোন আঁচ লাগেনি। সীমাকে উদ্ধার করে প্রতিবেশীরাই প্রথমে হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে খবর পায় তার পরিবার। সীমার ভাইয়ের ছেলে শুভাশিস মিত্র সেদিন সীমার পাশে হাসপাতালে ছিলেন।

তিনি বলছিলেন “ আমার ফুফু রাতে ঘুমাতে যায়। রাত একটার দিকে তার চিৎকারে পাশের বাসার কয়েকজন আসেন। কিন্তু আমার ফুফুর স্বামী দরজা খোলেননি। পরে তারা প্রাচীর টপকে ঘরে ঢোকে। আশ্চর্যের বিষয় হল আমার ফুফা বাসায় ছিল, সে নির্বিকার এবং তার কোনো ক্ষতি হয়নি। আমরা খবর পেয়ে হাসপাতালে যেয়ে দেখি আমার ফুফুর শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে”।

হাসপাতালে নেওয়ার তিনদিন পর মারা যান সীমা মিত্র। মারা যাওয়ার সময় সীমা ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। এধরনের আচমকা মৃত্যু আর তার কারণ জানা না থাকায় হতবিহবল হয়ে পরে সীমার পরিবার। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে, তদন্তে বেরিয়ে আসে সীমার স্বামীর আরেকজন নারীর সাথে সম্পর্ক থাকার বিষয়টি।

গত বছরের মে মাসে রাজধানীর উত্তর বাড্ডার গোপীপাড়ায় দেবর ও ননদের হাতে বেধড়ক মারপিটের শিকার হন তিন সন্তানের মা মিনু আরা বেগম। খবর পেয়ে তার ভাই কামরুল হাসান ঘটনাস্থলে যান। উদ্ধার করেন বোনকে।

তিনি বলছিলেন “সেদিন আমার বোন রান্না ঘরে কাজ করছিল, তার স্বামী যেয়ে তাকে মারা শুরু করে, পরে তার দেবর-ননদ এসে গ্রিলের সাথে বেঁধে মারে। আমি খবর পেয়ে বোনকে রক্তাক্ত অবস্থায় পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাই।”

মিনু আরা বেগম তিনদিনের মাথায় মারা যান হাসপাতালে। ভাই কামরুল হাসানের ভাষায় সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের কারণে ঘটে এই হত্যাকাণ্ড। এ ধরণের পারিবারিক বিরোধের জের ধরে হত্যাকাণ্ডের খবর সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হচ্ছে হরহামেশা।

স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী, ভাইয়ের হাতে ভাই,বাবা-মার হাতে সন্তান, সন্তানের হাতে বাবা মাকে মারার ঘটনার খবর চাঞ্চল্য তৈরি করে। এর কোন কোন টি- খবরের পাতায় স্থান পায়, আর বেশির হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কোন খবর হয়না।

বাংলাদেশ পুলিশের এক পরিসংখ্যান বলছে পারিবারিক কলহের জের ধরে গত পাঁচ বছরে প্রায় ১০ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যার মামলা হয়েছে ।

বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল ইসলাম ভুঁইয়া বলছিলেন বছরে মোট হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৪০ শতাংশ হচ্ছে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড।

তিনি বলছিলেন “ ২০১০ সালে পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছিল ১৬৭৫টি, ২০১১ সালে ১৬৮৮টি এবং ২০১২ সালে ১৫৩৫। সুতরাং টোটাল যে হত্যাকাণ্ড হচ্ছে দেশে তার ৩৯-৪০ শতাংশ হচ্ছে এই পারিবারিক হত্যাকাণ্ড।”

গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ীর পূবালী এলাকার এক বাড়িতে গৃহবধূ সুরভী আক্তারকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন তার স্বামী সাজ্জাতুল ইসলাম রাসেল। পরদিন থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি।

কক্সবাজারে গত মে মাসে এক ব্যক্তি তার তিন মেয়েকে শিরশ্ছেদ করেন পারিবারিক অশান্তির জেরে, তিনিও পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। গত বছরের ১৩ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরে সালাহউদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ীকে হত্যার পর থানায় ফোন করে খবর দেন তার স্ত্রী লাবনী আক্তার। পুলিশ লাবনীকে গ্রেপ্তার করে । এসব ঘটনা গণমাধ্যমে খবর হলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কোন কারণে মতের অমিল হলে বা বিরোধ হলে সেটা কেন হত্যার পর্যায়ে যাচ্ছে? বা মানুষের মধ্যে পরিবারের সদস্যদের খুন করার এই প্রবণতা কেন? এসব বিষয় নিয়ে আমি কথা বলেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়াউর রহমানের সাথে।

অধ্যাপক রহমান বলছিলেন “ বাংলাদেশের যে ট্র্যাডিশনাল ভ্যালু নিয়ে দীর্ঘদিন চলতো সেখান থেকে হঠাৎ করে জাম্প করেছে, সাথে যোগ হয়েছে গ্লোবালাইজেশন”। “ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও আকাশ সংস্কৃতির কারণে এবং দ্রুত কম্পিউটার, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দ্রুত মডার্ন ভ্যালুস গুলো বাংলাদেশের সোসাইটির মধ্যে চলে আসছে” উল্লেখ করছিলেন তিনি। তিনি বলছিলেন “এসব কারণ আলটিমেটলি একটা সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হচ্ছে। এটা একটা বড় কারণ এছাড়া, মানুষের হাতে এখন টাকা পয়সা চলে এসেছে। ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কের নতুন রূপ দেখতে পাচ্ছি।”

গত কয়েক বছরের ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দাম্পত্য কলহ, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্ক, যৌতুক, মাদকাসক্ত এসব বিষয় রয়েছে হত্যাকাণ্ড গুলোর মূল কারণ হিসেবে।

২০১০ সালে সম্পত্তি ও টাকা পয়সা নিয়ে বিরোধের জের ধরে বাবা মোঃ. শহিদুল্লাহকে ঘুমন্ত অবস্থায় কুপিয়ে খুন করেন ছেলে বদরুল। চলতি মাসের ২২ তারিখে খুলনার একটি আদালত বদরুলকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কিন্তু এ ধরণের রায় আসতে সময় লাগে বেশ কয়েক বছর। পরিবারের এক সদস্যের হাতে যখন আরেক সদস্য নিহত হন তখন সেই মামলা চূড়ান্ত রায় বা মামলার নিষ্পত্তি কি পরিমাণ হচ্ছে ?

পারিবারিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন আইনজীবী শাহিন মমতাজ বলছিলেন, এর কোন পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও দীর্ঘ দিনের পর্যবেক্ষণে তিনি দেখেছেন বেশির ভাগ মামলা কয়েক বছর পর পরিবারের মধ্যেই আপোষ-রফা করে ফেলার হার সবচেয়ে বেশি।

তিনি বলছিলেন “প্রথমত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে হত্যাকাণ্ড হলে যদি কোন শিশু জীবিত থাকে তাহলে সে মামলা অবধারিত ভাবে মিউচুয়ালের দিকে যেতে দেখেছি। এছাড়া বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘ সময় লাগার কারণে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তাৎক্ষনিক যে মানসিক অবস্থা থাকে সেটা কেটে যায়। ৫/৭ বছর পর তারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে আদালতে মামলা তুলে নেয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। আর ১০/১৫ বছর ধরে মামলা চালিয়ে রায় পাওয়া পর্যন্ত খুব কম মামলা চলে বলে আমাদের কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি।”

বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় দ্রুত বিচারের বিধান রয়েছে। তবে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা হত্যার শিকার হলে সেটা খুনের মামলা হিসেবেই পরিচালিত হয়। ফলে অন্যান্য খুনের মামলার মতো পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের বিচার চলে।

পুলিশের অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল ইসলাম ভুঁইয়া বলছিলেন এটি একটি সামাজিক অপরাধ হলেও আলাদা করে বিচার পরিচালনা করার জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা এখনো বাংলাদেশে নেই। তাছাড়া অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলার কাজ করতে যেয়ে আরও দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে পড়ে যায় এই মামলাগুলো।

শুরুতে সীমা মিত্রের কথা বলছিলাম- তার হত্যাকাণ্ডের রায় হয়েছিল ঘটনার ২০ বছর পর। আদালতে প্রমাণিত হয় স্বামী প্রহলাদ চন্দ্র দে’র বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জেনে যাওয়া এবং না মেনে নেওয়ার কারণেই স্বামীর হাতে খুন হন সীমা মিত্র। প্রহলাদ মিত্রের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

আর মিনু আরা বেগমের স্বামীসহ আরো আটজনকে আসামী করে মামলা করা হয়। যাদের মধ্যে ৭ জন এখন জামিনে বাকি একজন পলাতক। এখন মামলা লড়ছেন তার ভাই কামরুল হাসান। তবে এই দুই ঘটনার যে বিচারিক প্রক্রিয়া- সেটা, হাতেগোনা ঘটনা গুলোর মতই। কারণ পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের পর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সমঝোতা করে ফেলার ঘটনা যেন বেশি উদাহরণ সৃষ্টি করছে ।- বিবিসি



মন্তব্য চালু নেই