একটা আইফোন চেয়েছিলেন মুস্তাফিজ
স্কুল ফাঁকি দিয়ে মোস্তাফিজের সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস হয়ে উঠার গল্প, আনন্দে সাতক্ষীরাবাসী
সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার তারালি ইউনিয়নের তেতুলিয়া গ্রামের ছেলে মুস্তাফিজ। বরেয়া জিলানী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র সে। অনুর্দ্ধ ১৬, ১৮ ও ১৯ সাতক্ষীরা জেলা দলের খেলোয়াড়।
ব্যবসায়ী বাবা আলহাজ্ব আবুল কাশেম গাজী, মা মাহমুদা খাতুনের শেষ ছেলে হিসেবে তাদের কোল আলোকিত করে ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ সালে জন্ম নেয় মুস্তাফিজ সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার তারালি ইউনিয়নের তেতুলিয়া গ্রামে। চার ভাই ও দুই বোনের সংসারে বেড়ে উঠা মুস্তাফিজের। তার বড় ভাই মাহফুজার রহমান মিঠু খুলনায় গ্রামীনফোনের টেরিটরি অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন, মেজ ও সেজ ভাই ঘের ব্যবসায়ী।
তার ক্রিকেট খেলায় আসার পিছনে সেজ ভাই মোখলেসুর রহমানের অবদান অনেক। ক্রিকেট পরিবারে জন্ম নেওয়া মোস্তাফিজকে তাকাতে হয়নি পিছনে ফিরে। তার বড় ভাই এক সময় ক্রিকেট খেরতেন, মেজ ভাইও কম যান না, আর সেজ ভাই এখনও ক্রিকেট খেলেন।
তার সেজ ভাই মোখলেছুর রহমান পল্টু জানালেন, তার উঠে আসার ইতিহাস, এই তো বছর পাঁচেক আগের কথা। সাতক্ষীরায় অনুর্ধ-১৪ ক্রিকেটে বাছাই পর্বে নজর কাড়ে সবার। তারপর তিন দিনের ছোট কোচ করানো হয়।
এরপর জেলা পর্যায়ে অনূর্দ্ধ-১৬ ক্রিকেট খেলায় সাতক্ষীরার হয়ে প্রথম মাঠে নেমেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। পড়াশোনায় অতটা মন তাঁর কখনোই ছিল না। স্কুল ফাকি দিয়ে সে ক্রিকেট খেলতে যেত। বাসায় তো বলেই দিয়েছিলো, আমার দ্বারা ওসব হবে না। তোমরা আর জোর করো না। এরপর থেকে ক্রিকেটই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। কালিগঞ্জের বরেয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে নেট প্যাকটিস করতেন মুস্তাফিজ।
সাতক্ষীরা গণমুখী সংঘের কোচ আলতাফই প্রথম ধরতে পেরেছিলেন মুস্তাফিজের ভেতরের ‘ধারটা’। হিরে চিনে নিয়ে ঘষামাজার কাজটি তিনি শুরু করে দেন। জেলা পর্যায়ে এসে মুস্তাফিজকে আরও পরিণত করে তুলতে পরিশ্রম করেন সাতক্ষীরার জেলা কোচ মুফাসিনুল ইসলাম তপু। সকলের পরিশ্রমের প্রতিদান দিতে পেরেছেন মুস্তাফিজ। পাকিস্তারে বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তাঁর পারফরম্যান্সই বলছে সে কথা। জেলা পর্যায়ের পর খুব বেশি দিন তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়নি। ডাক পেয়ে যান খুলনার বিভাগীয় দলে খেলার। বছর তিনেক আগে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ফাস্ট বোলিং ক্যাম্পে ট্রায়াল দিতে এসে কোচরা আর ছাড়েননি এই প্রতিভাকে। নিয়মিতই অনূর্দ্ধ-১৯দলে খেলেছেন। বল করতেন জাতীয় দলের নেটেও। তবে সম্ভবনার দ্রুতি ছড়িয়েছেন গত বছর অনূর্দ্ধ-১৯ বিশ্বকাপে। তার ঝুলিতে ভরেছিলেন ৯ উইকেট। হয়েছিলেন দ্বিতীয় সবোচ্চ উইকেট শিকারী।
গত বছরের মে মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বাংলাদেশ ‘এ’ দলেও স্থান পেয়েছিলেন মুস্তাফিজ। রীতিমতো চমক ছিলেন তিনি। মুস্তাফিজ প্রথম শ্রেণিতে খেলা শুরু করেন গত বছর এপ্রিলে। এই তো ছয় মাস আগে অভিষেক হয়েছে ঘরোযা এক দিনের ম্যাচে।
অভিষেক ম্যাচের চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্স তাই ‘নতুন দিনের বাংলাদেশ’ দলে ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করবে বলেই পূর্বাভাস দিচ্ছে। সব মিলিয়ে বলা যায় নতুন বিস্ময় হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে আবির্ভুত হলেন এই তরুণ পেসার।
মুস্তাফিজুর রহমানের ক্রিকেট কোচ আলতাফ হোসেন বলেন, সৌম্য এবং মুস্তাফিজ দুজনই আমারই ছাত্র। দুজনই যে এক সাথে জাতীয় দলে খেলছে একজন বোলার আরেকজন ব্যাটসম্যান। এর চেয়ে আনন্দের ব্যাপার আমার কাছে আর কিছু হতে পারে না।
মুস্তাফিজের আরেক কোচ মুফাস্সিনুল ইসলাম তপু জানান, তার সেজ ভাই তাকে নিয়ে যখন আমার কাছে আসে,তার বোলিং দেখি বুঝেছিলাম, সে ভালো করবে। সে তো প্রথমে ব্যাটিং করতে চেয়েছিল। আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম বোলিং করার জন্য। আমার ছাত্র জাতীয় দলে খেলছে, এতে আমি গর্বিত।
মুস্তাফিজের বিশ্ব রেকর্ড: বাঁধভাঙ্গা আনন্দে ভাসছে গোটা সাতক্ষীরাবাসী
তখনও মুস্তফিজের এক বল বাকি। তারা বলছিল মুস্তাফিজ হয়তো শেষ বলে উইকেট পেতে পারে। খেলা শুরু হওয়া মাত্র তাদের কথা সত্যিই রাখলো মুস্তাফিজ। নিয়ে নিলেন ভারতীয় খেলোয়াড় জাদেজার উইকেট।
সাতক্ষীরা শহরের একটি চায়ের দোকানে বসে বাংলাদেশ বনাম ভারতের মধ্যকার ক্রিকেট ম্যাচ দেখছিল আলি হোসেন, জুয়েল, সোনা, শহিদুল, হাবিবুল্লাহ কয়েকজন যুবকসহ মাঝ বয়সী কয়েকজন ক্রিকেট প্রেমী। বৃষ্টির বাধায় খেলা বন্ধ থাকায় তখন সেই ফাকে চলছিল এসব আলাপচারিতা।
তারা বলছিল, সাতক্ষীরা মুস্তফিজ এই কী খেলা দেখাচ্ছে! ভারতের বিপক্ষে প্রথম ওডিআই ম্যাচে ৫ উইকেট নেওয়ার পর দ্বিতীয় মাচেও ৬ উইকেট নিয়ে সে যেন তার নাম ইতিহাসে স্বর্ণ অক্ষরে নিজের নাম লিখালেন সাতক্ষীরার কৃতি সস্তান মুস্তাফিজুর রহমান। সত্যি অসাধারণ বল করছে মুস্তফিজ। গত ম্যচে ধোনির ধাক্কার প্রতিশোধও নিলেন মুস্তফিজ।
এটি বলছি সাতক্ষীরা শহরের একটি চায়ের দোকানের খন্ডচিত্র মাত্র। গতকালের ম্যাচে মুস্তফিজের ছয় উইকেট পাওয়ায় আনন্দে ভাসছে গোটা সাতক্ষীরা বাসী। তার এই বিশ্ব রেকার্ড অভিভূত গোটা জেলাবাসী। খেলা শেষ হওয়ার আগেই অনেক জায়গায় আনন্দ মিছিল বের করেছে মুস্তফিজের ভক্তরা।
অভিষেকে ম্যাচে ৫ উইকেটে নেওয়ার পর পরেই ম্যাচে ছয় উইকেট নেওয়া দ্বিতীয় ও দশম বোলার এই সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস। প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ৫০ রানে ৫ উইকেট নেবার পর এবার ৪৩ রানে ৬ উইকেট তুলে নেন এই পেসার।
তার এই বিশ্বরেকর্ড ঘিরে তার গ্রামের ক্রিকেটার বাড়ি সাতক্ষীরা কালিগঞ্জ উপজেলার তারালি ইউনিয়নের তেতুলিয়া গ্রামে বইছে বাঁধভাঙ্গা আনন্দ। বাঁহাতি পেসার, ইন সুয়িং এবং অফ কাটার দিয়ে ১ম ম্যাচের মত ২য় ওডিআই ম্যাচেও ভারতের বাঘা বাঘা নাজেহাল করে দিলেন এক তরুণ বোলার। তার এই বিশ্ব রেকর্ড (প্রথম ম্যাচে ৫ ও দ্বিতীয় ম্যাচে ৬ উইকেট) ঘিরে মুস্তফিজের গ্রাম সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়ায় শুরু হয়েছে যেন ঈদের আনন্দ। চলছে মিষ্টি বিতরণ। বাবা-মাকে অভিনন্দন জানাতে বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছেন নানা শ্রেণির মানুষ। বড় পর্দায় খেলা দেখতে তেঁতুলিয়া ফুটবল মাঠে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। এ ছাড়া বাজারের দোকানে দোকানে খেলা দেখা নিয়ে সর্বত্র যেন চলছে উৎসব।
মোস্তফিজের ক্রিকেট গুরু আলতাফ হোসেন ও মুফাস্সিনুল ইসলাম তপু জানালেন ছাত্রের এই অর্জনে তাদের অনুভূতির কথা, পাঁচ উইকেট ও ছয় উইকেট পাওয়া প্রত্যেক খেলোয়াড়ের জন্য সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। তার এই অর্জনে কোচ হিসেবে গর্বিত এবং আনন্দিত তারা।
মুস্তফিজের বড় ভাই মোখলেসুর রহমান জানান, আমার ভাইয়ের এই অর্জনে আমরা খুবই খুশি। পরিবারের সবাই মিলে একসাথে তার খেলা দেখেছি, তার সাথে কথা হয়েছে। আমরা সবাই আনন্দিত।
মুস্তফিজের বাবা আলহাজ্ব আবুল কাশেম গাজী জানালেন তার অনুভূতি, আমার ছেলের এই অর্জনে সত্যি আমি আনন্দিত যা ভাষায় প্রকাশ করার মত না।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে মুস্তফিজকে নিয়ে লিখছে নানা স্ট্যাটাস। রোববার ভারতের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে শুরু থেকেই দুর্দান্ত বল করে আসছেন সাতক্ষীরার এই তরুণ। ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই দেখার তার ভেলকি ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান অর্জনকারী ব্যাটিং রোহিতকে। এরপর একে একে তুলে নেন ধোনি, রায়না, অক্ষর, আশ্বিন এবং জাদেজাকে। এর আগে হারারেতে জিম্বাবুয়ের ব্রায়ান ভিটোরি বাংলাদেশের বিপক্ষেই অভিষেকে টানা দুই ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন।
একটা আইফোন চেয়েছিলেন মুস্তাফিজ
ভারতের বিরুদ্ধে ওডিআই সিরিজে ডাক পাবার পর পরই তরুন মুস্তাফিজুর রহমান তার চাচার কাছে একটা আইফোন সিক্স প্লাস চেয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী চাচা তার ভাতিজাকে বলেছিলেন, তিনটি ম্যাচের যে কোন একটিতে তিন উইকেট পেলেই তাকে কিনে দেবেন আইফোন সিক্স প্লাস। চাচা সম্ভবত ভাতিজার সত্যিকারের সম্ভাবনা ধারণা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। চাচার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি এখন একটি কেন তিনটি আইনফোন পেতে পারেন মুস্তাফিজ। মিরপুরে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ছয় উইকেট নিয়ে মুস্তাফিজ যখন ইতিহাসে নাম লেখালেন তার পর চাচার সঙ্গে তার কথা হয়েছে কিনা জানা যায়নি।
তবে নিশ্চয় চাচা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি একটি বা একাধিক আইফোন কিনে ফেলেছেন এতোক্ষণে। আর নিজে কিইবা প্রশংসা করবেন মুস্তাফিজের। পুরো ক্রিকেট দুনিয়া যে এখন মুস্তাফিজ বন্দনায় ব্যস্ত। এতো প্রাপ্তির পর মুস্তাফিজ যখন দুই হাতে ঢেকে রাখতে চাইছেন লাজুক মুখটি তখন তাবৎ দুনিয়ার ক্রিকেট ভক্তরা জানতে চাইছেন এই ‘ক্ষুদে বিস্ময়ের’ আরও কিছু।
মন্তব্য চালু নেই