একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার ঘৃণ্যতম ইতিহাস
গ্রামের সহজ-সরল ছেলে। এসএসসি ও এইচএসিতে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে জায়গা করে নিলেন। উচ্চশিক্ষা নিতে এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেও অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলেন। তারপর?
তারপর রচিত হল বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ঘৃণ্যতম ইতিহাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তরে লুকিয়ে থাকা শ্রেণী ঘৃণা, বিদ্বেষ আর জিঘাংসার শিকার হয়ে মেধাবী শিক্ষককে চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে যেতে হল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আধাপেট খাওয়া শিক্ষক হিসেবে ধুকে ধুকে মরতে হল।
হ্যা, আমরা অধ্যাপক আনিছুর রহমান স্যারের কথা বলছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এই সাবেক শিক্ষক আর নেই। (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
রবিবার দিনগত রাত ৩টায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চিওড়া ইউনিয়নের তৈয়াসার গ্রামের নিজ বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন।
মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী মুন্নী আক্তার ও ছোট দুই বোনসহ আত্মীয়-স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহীকে রেখে গেছেন।
সোমরার বিকাল সাড়ে ৫টায় নামাজের জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।
আনিসুর রহমান ১৯৬০ সালে চৌদ্দগ্রামের তৈয়াসার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ পুলিশের কর্মকর্তা ছিলেন,মা মাহমুদা খাতুন গৃহিণী। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।
আনিছুর রহমান চিওড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পনের বছর বয়সে ১৯৭৫ সালে চিওড়া বেগম ফয়জুন্নেসা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান এবং ১৯৭৭ সালে একই বোর্ডের একই বিভাগ থেকে এইচএসসিতে পুনরায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।
পরবর্তীতে আনিছুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করে স্নাতক সম্মান (অনার্স) ও স্নাতোকত্তর (মাস্টার) ডিগ্রী অর্জন করেন।
মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন আনিছুর রহমান। দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মাত্র সাত বছর শিক্ষকতা করার সুযোগ পান এই শিক্ষক। এরপর ১৯৮৯ সালে তাকে বিশ্ববিদ্যিালয়ের চাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে হয়। তখন তার বয়স ২৯ বছর।
কী ছিল আনিছুর রহমানের অপরাধ? গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকরা বরাবরই আনিছুর রহমানের প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তারপরেও বিভাগের সবচেয়ে বড় কলঙ্কের ঘটনাটি কোনো না কোনো ভাবে শিক্ষার্থীরা জেনে যান।
আনিছুর রহমানের অপরাধ ছিল প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা একজন সহজ সরল মানুষ ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার দম্ভ, মেকি পার্সোনালিটি আর সামন্ত আচরণে তিনি অভ্যস্ত হতে পারছিলেন না। বরং সাহেবি প্রথা ভেঙে তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে বন্ধুদের মতো মিশে যেতেন।
গেয়ো, অসংস্কৃত ও আনস্মার্ট আচরণ থেকে বেরিয়ে আসতে আনিছুর রহমানকে অনেক বার শাসানোও হয়। কিন্তু সারল্য আর সহজ জীবনে অভ্যস্ত আনিছুর পড়াশোনা ছাড়া আর কিছুতেই সিরিয়াস হতে পারেননি। যাদের জীবনের কোনো পর্যায়ের উচ্চ শিক্ষাই তার সমান নয় তাদের থেকে আলাদা করতেই যে তিনি স্মার্ট দেখাতেন না তা অবশ্য কখনোই মুখে বলেননি তিনি।
এক পর্যায়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে আনিছুর রহমানকে এক ঘরে করে ফেলা হয়। তার সাথে উচ্চকোটির শ্রেণীদম্ভে বিশ্বাসী শিক্ষকরা কেউ কথা বলতেন না। গোপনে শিক্ষার্থীদেরও লেলিয়ে দেয়া হয় তার বিরুদ্ধে। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করা হয় তাকে। আঘাত করা হয় তার মানিবক মর্যাদায়।
একদিন সব ছেড়েছুঁড়ে তৈয়াসা গ্রামে ফিরে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ মেধাবী শিক্ষক আনিছুর রহমান। গ্রামের মানুষ প্রথমে অবাক হলেও সারল্য আর মিশুক স্বভাব দেখে সবাই তাকে বুকে টেনে নেন।
পাগলাটে অপবাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দেওয়া আনিছুর রহমান কিন্তু শিক্ষকতা পেশা ছাড়েননি। স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসিবে যোগ দেন তিনি। দরদ দিয়ে পড়িয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে অসামান্য জনপ্রিয়তাও অর্জন করেন তিনি।
আনিছুর শেষ পর্যন্ত সংসারিও হয়েছিলেন। তিনি মুন্নী আক্তার নামে এক তরুণিকে বিয়ে করেন। অবশ্য আনিছ-মুন্নী দম্পতি ছিলেন নিঃসন্তান।
মেধাবী আনিছুর রহমান উচ্চ শিক্ষিত সমাজের কূটিলতায় শিকার হয়ে কষ্টকর জীবন যাপন করতে গিয়ে এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। খুব কম বয়সেই তার শরীর ভেঙে পড়ে, দ্রুত তিনি বুড়িয়ে যেতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।
সর্বশেষ বারডেম হাসপাতাল ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ (কুমেক) হাসপাতালে ধারাবাহিক চিকিৎসার মধ্যেই রবিবার রাতে আনিছুর রহমান মারা যান।
আনিছুর রহমানের সরাসরি ছাত্র ছিলেন এমন অনেকেই এখন বাংলাদেশের সংবামাধ্যমের উচ্চপদগুলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কেউ কেউ সম্পাদক পদেও আসীন আছেন। তার ছাত্র ও ছাত্রীরা সাংবাদিকতার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও নিজেদের শিক্ষকের দুঃখ আর বেদনাবোধ ঘুচাতে পারেননি তারা। প্রতিকার তো দূর কল্পনা। অবশ্য তাদের অনেকে এই শিক্ষকের খোঁজখবরও রাখেননি। স্বীকার্য কেউ কেউ শেষ বেলায় শাপমোচনের উদ্যোগ নেন, দীপ নেভার কিছুক্ষণ আগে তার অসুখে শরীরটা সারানোর চেষ্টা করেন তারা।
মৃত্যুর পর আনিছুর রহমানের জন্য একটি শোকবাণী ইস্যু করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, ‘আনিসুর রহমান ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী শিক্ষক। সাংবাদিকতা শিক্ষার ক্ষেত্রে তার কর্মকান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবে’।
ভিসি মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার পরিবারের শোক-সন্তপ্ত সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
সম্ভবত আনিছুর রহমানের মৃত্যুর পর তড়িঘড়ি শোকবাণীর চেয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করাই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র কর্তব্য, বিশেষ করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের।
দুঃসহ জীবন থেকে বিদায় আনিছুর রহমান স্যার, ক্ষমা প্রার্থনায় নত হও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়!
মন্তব্য চালু নেই