পবিত্র শবে মিরাজ : ঘটনাবহুল এক রাত্রি
পবিত্র শবে মিরাজ এক অসামান্য রজনী। যে রাত্রে ঘটেছিল অবাক করার মতো তাৎপর্যময় কিছু ঘটনা। যা মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ রাতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহ তায়ালার দিদার লাভ করেন। অবলোকন করেন সৃষ্টিজগতের সমস্ত কিছুর অপার রহস্য।
নবুওয়াতের একাদশ বছর ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। ধর্মীয় চিন্তাবিদগণ মনে করেন পবিত্র শবে মিরাজ হচ্ছে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে এক সম্মানজনক শুভযাত্রার মাধ্যমে সংবর্ধনা প্রদান। এই রাতে ‘বোরাক’ নামীয় স্পেশাল বাহনে চড়ে যে শুভযাত্রার সূচনা হয়। এরপর বিরতিহীন যাত্রার পর প্রথমে তাকে সিরিয়ার মসজিদে আক্বসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে আগে থেকেই পূর্বেকার সকল আম্বিয়ায়ে কেরামকে সমবেত রাখা হয় মহানবী (সা.)কে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়ার জন্য।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি এভাবে সাজানো ছিল। প্রথমে হযরত জিব্রাঈল (আ.) আযান দিলেন এবং মহানবী (সা.) নামায আদায়ের জন্য অপেক্ষমান সকল নবী-রাসূল ও ফেরেশতাদের ইমামতি করলেন। তিনি হলেন ইমামুল মুরসালিন। এরপর তাকে আল্লাহর নির্দেশে পর্যায়ক্রমে আসমানসমূহে ভ্রমণ করানো হয়। প্রথম আসমানে আদম (আ.) এর সঙ্গে, দ্বিতীয় আসমানে ঈসা (আ.) এর সঙ্গে, তৃতীয় আসমানে ইউসুফ (আ.) এর সঙ্গে, চতুর্থ আসমানে ইদরিস (আ.) এর সঙ্গে, পঞ্চম আসমানে হারুন (আ.) এর সঙ্গে, ষষ্ঠ আসমানে মুসা (আ.) এর সঙ্গে, সপ্তম আসমানে ইবরাহিম (আ.) এর সঙ্গে সাক্ষাত হয়। (বুখারী শরীফ, ফাতহুল বারী)
এরপর তিনি ‘সিদরাতুল মুনতাহার’ দিকে সফর শুরু করেন। পথিমধ্যে হাউজে কাউসার অতিক্রম করেন। এরপর তিনি জান্নাতে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি আল্লাহর সব নিয়ামতের দর্শন লাভে সক্ষম হন। জান্নাতে থাকা স্পেশাল সব নেয়ামত দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
এরপর তাঁর সামনে হাজির করা হয় জাহান্নাম। যা ছিল সর্বপ্রকার আযাব-গযবে ভরপুর। তাতে তিনি একদল লোককে দেখলেন যারা মৃত জন্তুর গোশত খাচ্ছে। প্রশ্ন করলেন এরা কারা। উত্তরে জিব্রাঈল (আ.) বললেন, এরা আপনার উম্মতের সেসব লোক যারা দুনিয়াতে নিজ ভাইদের গোশত খেত অর্থাৎ গীবত করত। এরপর দোযখের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত জিব্রাঈল (আ.) সফরসঙ্গী ছিলেন।
এরপর মহানবী (সা.) মহান আল্লাহতায়ালার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় মগ্ন হন। আল্লাহ তালার দর্শনে মনোনিবেশ করেন। সেখানে মহানবী (সা.) সৃষ্টিকর্তার সামনে সেজদায় পড়ে যান। মিরাজ এই রজনীতে আল্লাহ তালা স্পেশাল গিফট হিসেবে নামায দিয়েছেন। তাই নামাযকে বলা হয় মুমিনের মিরাজ। প্রভাতের আগেই কল্যাণময় এ সফরের সমাপ্তি ঘটে।
মিরাজ ইসলামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। যে ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য একমাত্র রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এরই হয়েছিল। এ মিরাজের রাতেই মানব জাতির শ্রেষ্ঠ ইবাদত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও যথাযথ মর্যাদায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আজ কোরআনখানি, জিকির আসকার, ওয়াজ মাহফিল, দোয়া-দরুদ পাঠ ও বিশেষ মোনাজাতের মাধ্যমে পবিত্র শবে মিরাজ পালন করবেন।
মিরাজ আরবি শব্দ, অর্থ ঊর্ধ্বারোহণ। ঊর্ধ্বলোকে পরিভ্রমণ। নবুওয়াতের একাদশ সালের ২৭ রজব রাতের শেষ প্রহরে মহানবী (সা.) ফেরেশতা জিব্রাইলের (আ.) সঙ্গে বায়তুল্লাহ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ‘বোরাক’ নামের বাহনে করে ভ্রমণ এবং সেখান থেকে অলৌকিক সিঁড়ির মাধ্যমে সাত আসমান পেরিয়ে আরশে আল্লাহর সান্নিধ্যে যান। পুনরায় বায়তুল মুকাদ্দাস হয়ে বোরাকে আরোহণ করে প্রভাতের আগেই মক্কায় নিজ গৃহে ফিরে আসেন।
হাদিসে হাসান (রহ.)-এর বর্ণনায় আছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি হিজরে হাতিম কাবার বহিরাংশে ঘুমিয়ে ছিলাম। এ অবস্থায় জিব্রাইল আসেন, আমাকে পায়ে খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে তোলেন, আমি উঠে বসি কিন্তু কাউকে না দেখে পুনরায় শুয়ে পড়ি। তৃতীয়বার সে আমার বাহু ধরে, আমি তার সাথে দাঁড়িয়ে যাই।
অতঃপর আমাকে মসজিদের দরজার কাছে নিয়ে আসে, সেখানে লক্ষ করি, অদ্ভুত আকৃতির একটি প্রাণী, যাকে গাধাও বলা যায় না আবার তা ঘোড়ার মতোও না। ঊরুতে বিশাল দুটি পাখা, যার মাধ্যমে সে পায়ে আঘাত করে। এর নাম বোরাক। আগের যুগের নবীগণ এর ওপরেই আরোহণ করতেন। আমাকে তার ওপর আরোহণ করাল। জিব্রাইল আমিনের সাহচর্যে আমি আসমান-জমিনের বিচিত্র নিদর্শন দেখতে দেখতে বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছি।
সেখানে অবতরণ করে জিব্রাইল দরজার আংটার সঙ্গে বোরাক বাঁধেন, আমি লক্ষ্য করি, ইবরাহিম, মুসা ও ঈসা (আ.)দের সঙ্গে আরো অনেক নবী একত্র হয়েছেন সেখানে। মুসা (আ.)-এর আকৃতি একটি উপমাযোগ্য দেহের ন্যায়। শানুয়া বংশের পুরুষদের মতো অনেকটা। কোঁকড়ানো চুল, হালকা গড়ন, লম্বা শরীর।
ঈসা (আ)-এর আকৃতি মাঝারি গড়ন, ঝুলন্ত সোজা চুল, চেহারা সৌন্দর্য তিলকে ভর্তি। মনে হচ্ছিল তিনি গোসলখানা হতে বের হয়েছেন, পানি পড়ছে মাথা হতে, প্রায় উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফির মতো। ইবরাহিমের আকৃতি আমার মতো, আমি-ই তার সঙ্গে সর্বাধিক সাদৃশ্যপূর্ণ।
অতঃপর আমার সামনে দুটি পেয়ালা : একটি মদের অপরটি দুধের পেশ করা হয়। আমাকে বলা হলো : যেটা ইচ্ছে পান করেন, আমি দুধের পেয়ালা হাতে নিই এবং পান করি। আমাকে বলা হয়, সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যদি আপনি মদের পেয়ালা হাতে নিতেন, পান করতেন, আপনার উম্মত গোমরাহ হয়ে যেত। (অপর একটি বর্ণনায় পানির তৃতীয় আরেকটি পেয়ালার উল্লেখও পাওয়া যায়।)
অতঃপর তিনি প্রথম আসমানে আরোহণ করেন, রাসুল (সা.)-এর জন্য দরজা খুলতে বলা হয়, দরজা খুলে দেওয়া হয়। সেখানে আদম (আ.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। তার ডান পাশে জান্নাতিদের রুহ এবং বাম পাশে জাহান্নামিদের রুহ প্রত্যক্ষ করেন। অতঃপর দ্বিতীয় আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে ইয়াহইয়া ইবনে জাকারিয়া ও তার খালাতো ভাই ঈসা ইবনে মারইয়ামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। অতঃপর তৃতীয় আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। অতঃপর চতুর্থ আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে ইদরিস (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। অতঃপর পঞ্চম আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে মুসা (আ.)-এর ভাই হারুন ইবনে ইমরানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়।
অতঃপর ষষ্ঠ আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে মুসা ইবনে ইমরানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। রাসুল (সা.) তাঁর থেকে বিদায় নিলে তিনি কেঁদে ফেলেন। জিজ্ঞাসা করা হলো, কী জন্য কাঁদেন? তিনি বলেন, এ জন্য কাঁদি, আমার পরে একজন যুবক প্রেরণ করা হয়েছে, তার উম্মত আমার উম্মতের চেয়ে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করবে।
অতঃপর সপ্তম আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সকলেই তাঁকে অভিবাদন, স্বাগত, অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন, তাঁর নবুয়তের স্বীকারোক্তি প্রদান করেন।
এরপর সিদরাতুল মুন্তাহায় পৌঁছেন, যার ফল যেন হাজার হাজার কলসি, পাতা হাতির কানের মতো, যা স্বর্ণের পতঙ্গ, আলোকোজ্জ্বল, বিচিত্র রং বেষ্টিত। যে সৌন্দর্য বর্ণনা করার সাধ্য কারো নেই।
এরপর বায়তুল মামুরে আরোহণ করেন, যেখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করে, যাদের কেউই কিয়ামতের পূর্বে পুনরায় প্রবেশ করার সুযোগ পাবে না। এরপর জান্নাতে প্রবেশ করেন, যার ভেতর স্বর্ণের রশি, কস্তুরীর মাটি প্রত্যক্ষ করেন।
আরো উপরে উঠে কলমের আওয়াজ শুনতে পান। অতঃপর আল্লাহ তাআলার নিকটবর্তী হন, ধনুক বা তার চেয়ে কম দূরত্বের ব্যবধানে। অতঃপর তাঁর প্রতি, যা ইচ্ছে ছিল, ওহি করেন। পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়। ফেরার পথে মুসা (আ.)-এর পরামর্শে পুনরায় আল্লাহর দরবারে পুনঃপুন গিয়ে শেষাবধি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়ে আসেন।
কয়েকটি সূত্রে বর্ণিত, এ সফরের প্রাক্কালে তার বক্ষ মোবারক জমজমের পানি দ্বারা বিধৌত করে নূর ও প্রজ্ঞায় পূর্ণ করা হয়।
মিরাজ সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কুরআন শরিফে বলেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি তাঁর স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করালেন, যার চতুর্দিকে আমার রহমত ঘিরে রেখেছেন-যেন আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। তিনিই সবকিছু শোনেন ও দেখেন । (বনি ইসরাইল-১)।
শবে মিরাজের ইবাদত সম্পর্কে হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) ও সালমান ফারসি (রা.) থেকে বর্ণিত, নিঃসন্দেহে রজব মাসে এমন একটি মহান দিন ও রাত রয়েছে, কোনো মোমিন যদি ঐদিনে রোজা রাখে ও রাতে নামাজে মশগুল থাকে, তার প্রতিদান হবে যেন সে ১০০ বছর দিনে নফল রোজা ও রাতে নফল নামাজ পড়েছে। সেই মহান রাতটি হলো রজবের ২৭তম রাত।
মন্তব্য চালু নেই