বামনদের নিজেদের এক গ্রাম

সবুজ গাছপালা, কিচিরমিচির পাখির ডাক, মাটির সোঁদা গন্ধ, বাঁশ ও বেতের ঘর- এই যেন আবহমান বাংলার গ্রামগুলোর বৈশিষ্ট্য। পাথর্ক্য শুধু মানুষের সংস্কৃতি। আর এ সংস্কৃতির কারণেই বিভিন্ন গ্রামের নাম হয় ভিন্ন। কোনো কোনো গ্রামের নামের পেছনে আবার ইতিহাসও লুকিয়ে থাকে। তাই বলে ‘বামনদের গ্রাম’ বলে কোনো গ্রামের নাম হতে পারে!

অবিশ্বাস্য হলেও এমনই একটি গ্রাম রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ভুটান সীমান্ত ঘেঁষা উদালওড়িতে। এ গ্রামের সবাই বামন।

টংলা বাজার থেকে এক কিলোমিটার দূরে এ গ্রামটির বসত ঘরগুলো চাটাই ঘেরা হলেও মানুষগুলোর মুখে বিষন্নতার বা হতাশার গ্লানি। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিনের পর দিন ‘উখো’ (লম্বা) মানুষদের তাচ্ছিল্য, ব্যঙ্গবিদ্রুপের সঙ্গে লড়াই করতে করতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে অবশেষে তারা এ গ্রাম তৈরি করেছেন। গ্রামের মানুষগুলোর উচ্চতা ৩ ফুটের বেশি নয়। অবশ্য এ গ্রামের স্বপ্নদ্রষ্টা নাটকপাগল পবিত্র রাভা কিন্তু বামন নন, আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই তার উচ্চতা।

২০০৩ সালে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে পড়া শেষ করে টংলায় নিজের প্রত্যন্ত গ্রামে ফেরা পবিত্র বামনদের প্রতি সমাজের অবহেলা দেখে মর্মাহত হয়েছিলেন। তাই বামনদের নিয়ে গড়ে তোলেন নাটকের দল দাপোন-এ (দর্পণ)। ২০০৮ সালে তাদের নিয়ে করলেন নাটকের কর্মশালা। পরে ২৩ জন বামন ও বিশালবপু সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মঞ্চস্থ করলেন নাটক ‘কিনো কঁও’।

গুয়াহাটি, কোকরাঝাড়, ডিব্রুগড় হয়ে সে নাটক পাড়ি দেয় দিল্লি। ‘স্বাভাবিক’ দর্শককুলের চেতনায় চাবুক মেরে যায় পবিত্র’র বামন বাহিনী। ‘দিল্লি জয়’ করে ফেরার পর শুরু হয় তাদের নিয়ে নতুন স্বপ্ন। এই স্বপ্ন হচ্ছে বাওনাদের (বামন) নিজস্ব একটি বসতের ঠিকানা। সেই থেকেই শুরু।

ওই গ্রামেরই বাসিন্দা অক্ষয়কুমার দাস জানালেন, “শিরদাঁড়াটা শক্ত হয়েছে খানিকটা। এমন একটা পৃথিবী গড়তে চলেছি, যেখানে কেবল উচ্চতার জন্য আপনাদের মতো মানুষদের কাছে খেলার জিনিস হয়ে থাকতে হবে না।”

১৮ বছর ধরে মুনলাইট সার্কাসে জোকারের চাকরি করা জেমস দইমারি বলেন, “আমরা ‘বাওনা’রা কাজ কিছু কম পারি না। হতে পারে, আমাদের দুঃখ-কষ্ট বাইরের সমাজ বোঝেনি। তবে, আমরা বুঝি শরীর কখন কী চায়।”

অক্ষয় ও জেমস, দু’জনই বিবাহিত। তবে স্ত্রীরা তাদের মতো বামন নয়, লম্বা। বেশক’টি সন্তানও রয়েছে তাদের। তাদের খোঁজ-খবরে নিয়মিত যান নিজ গ্রামে। তবে, বামনদের যৌথ পরিবার, হাতে হাতে নিজেদের নতুন গ্রামকে গড়ে তোলার স্বপ্নে মশগুল তারা। গ্রাম গড়া শেষ হলেই সপরিবারে চলে আসবেন এখানে।

বামনদের গ্রাম সম্পর্কে পবিত্র বলেন, “চার বিঘা এলাকায় পুকুর, অসমিয়া ও বড়ো মাধ্যমের স্কুল, পনেরোটির মতো থাকার ঘর, একটি নামঘর (উপাসনালয়), পাঠাগার, কর্মশালা, বৃত্তিমূলক শিক্ষার ঘর ও প্রেক্ষাগৃহ গড়া হবে। এক প্রান্তে, উন্মুক্ত মঞ্চও গড়ব ভাবছি। থাকবে প্রবীণ মানুষদের বসতি, ফুটবল ও বাস্কেটবল কোর্ট।’

তিনি বলেন, ‘দলে বর্তমানে ২৩ জন বামন থাকলেও আশপাশের সব এলাকা মিলিয়ে ৭০ জন বামন রয়েছেন। সবাইকেই এই গ্রামে নিয়ে আসতে চাই।’



মন্তব্য চালু নেই