শ্রমিকের কোন কান্নাই যেন মালিকদের কানে পৌঁছেনা

নিজ শ্রমের উপার্জন উত্তম ও পবিত্রতম। প্রতিটি শ্রমিক কাজ করে তার মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্য। মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন। মে মাস আসলে ঘটা করে এ দিনটি পালন করা হয়। এ দিবসটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। তন্মধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, মে দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন ও বামপন্থি আন্দোলনের উদযাপন দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রমিক হত্যা দিবস, লেবার ডে, ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কার ডে ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১ লা মে জাতীয় ছুটির দিন।

মে দিবসের সূচনার পেছনে রয়েছে স্মৃতিবিজড়িত একটি ইতিহাস। আজ থেকে ১৩১ বছর পূর্বে আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবার ১৮৮৪ খ্রি. ৭ অক্টোবর প্রথম আট ঘন্টা কাজের দাবী তোলে। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীর ‘হে মার্কেটে’র শ্রমিকরা ১৮৮৬ খ্রি. ১ মে ধর্মঘট ডাকে। এ ধর্মঘটে যোগ দেয় ৩ লক্ষ শ্রমিক। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৩ ও ৪ মে শ্রমিকদের এক সমাবেশে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে ১০ জন শ্রমিক নিহত হয়। ১৮৮৭ খ্রি. সাজানো মামলায় ফাঁসি দেয়া হয় ৪ জন শ্রমিককে। আন্দোলন অব্যহত থাকায় ১৮৮৯ খ্রি.আন্তর্জাতিক শ্রমিক কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেস। এই কংগ্রেসে শিকাগো নিহত শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও সংহতি প্রকাশের জন্য প্রতি বছর ১ মে দিনটি ঐক্যবদ্ধভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এভাবেই ১৮৯০ খ্রি. থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেণী দিবসটি পালন করে আসছে। ১৯৩৮ খ্রি.মে দিবস পালিত হয় নারায়নগঞ্জে। মে দিবসে ছুটি চেয়ে দাবী ওঠে সারাদেশে। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৭২ এর মে দিবসেই শেখ মুজিবুর রহমান ১লা মে কে ছুটির দিন ঘোষণা করার ফলে সে বছর থেকেই বাংলাদেশে মে দিবস পালিত হয় ব্যাপকভাবে। (বিশ্ব দিবস: ফারুক হোসেন)।

শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে লেখালেখি, সভা-সেমিনারের আয়োজন, টকশো, পোষ্টারিং, মাইকিংসহ নানা কর্মসূচী নেয়া হয়। সে শ্রমিকরা আজও তাদের ন্যায্য মজুরী থেকে বঞ্চিত। শিকাগো শহরের মতো বাাংলাদেশেও মজুরি বৃদ্ধিরদাবী, গার্মেন্টস থেকে অন্যায়ভাবে শ্রমিক ছাটাই ও শ্রমিকদেরকে নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় পুলিশের গুলি খেতে হয়। আমরা দেখেছি শ্রমিকদের দমন-পিড়নে করতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিজিবি সদস্যদেরকেও ব্যবহার করা হয়েছিল।

শ্রমিক তার দাবী নিয়ে কাঁদছে, আর মালিক যথারীতি হাসছে। শ্রমিকের কোন কান্নাই যেন মালিকদের কানে পৌছেনা । তাদের কান যেন মূর্তির কানের মতো হয়ে আছে। শ্রমিকরা তার মালিকের কাছে থ্রিজি, ফোর-জি চায়না। দর্শনীয় স্থান আর বিদেশ ভ্রমণের টিকিট চায়না। তাদের চাহিদা পরিবার নিয়ে দু’মুঠো খাবার খেতে, সন্তান কে স্কুলে পাঠাতে, মা-বাবা ও স্ত্রীর মুখে হাসি ফোটাতে। কিন্তু মালিকদের সেচ্ছাচারীতা ও যুলুমের কারণে তারা অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে।

শ্রমিক হওয়াতে যেন তার নেই কোন মানবতা। ভাল ব্যবহার করা হয়না, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্লভরে অবজ্ঞার সাথে ডাকা হয়। বাসা-বাড়িতে যেসব শ্রমিকরা কাজ করছে তারা গৃহ-বাড়ী-ফø্যাটের কর্তা ব্যক্তিদের দ্বারা অভাবনীয়, অসহনীয় নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা বহুবার পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। একান্তই অসহায় কাজের মেয়েটিকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ, রুটি তৈরীর বেলন দিয়ে পেটানো, খাবার খাইতে না দেয়া, প্রচন্ড শীতের মাঝেও বিছানাপত্র না দেয়া, রান্নার কাজে ব্যবহৃত লোহার সরঞ্জাম গরম করে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছেঁকা দেয়া, গরম তেল বা পানি শরীরে ঢেলে দেয়া, বেদম প্রহারের পরে মৃত ভেবে রাস্তায় ফেলে রাখার মতো জঘন্য ঘটনা প্রায়শ ঘটছে।

আদুরী নামের এক কাজের মেয়েকে এক পুলিশ সদস্য ডাস্টবিন থেকে তুলে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। তাকে নির্যাতনের মাত্রা এতই বেশী ছিল যে, এক বছরেও সুস্থ হতে না পেরে গত বছরের ১৭ এপ্রিল পূণরায় চিকিৎসার জন্য ঢামেক হাসপাতালে আসেন। আদুরীর বিষয়টি মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচারীত হওয়ায় আদুরী উন্ন্ত সেবা ও আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছে। আদুরীর মতো এমন অসহায় অনেক শ্রমিক আছেন যাদের কথা অজানাই থেকে যাচ্ছে। নিজের ছেলে যদি বড় ধরনের অন্যায় করে থাকেন, সেটা ক্ষমা করে দেয়া হয়। কিন্তু কাজের লোকটি সামান্য অপরাধ করলে কিংবা কোন কাজ করতে ভুলে গেলে বা বিলম্ব হলেই শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এধরনের নির্যাতনের ঘটনা বাসা-বাড়ীর কাজের লোক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীর ক্ষেত্রে খুব বেশী দেখা যায়। দিনের পর দিন মাসের পর মাস কাজ করতে হয় খেয়ে না খেয়ে। অতিরিক্ত খাটানো হয় কিন্তু সে তুলনায় পারিশ্রমিক দেয়া হয়না । এক শ্রমিক পালিয়ে গেলে অন্য শ্রমিকদের থেকে তার প্রতিশোধ নেয়া হয়। অধিকাংশ সময়ইট ভাটায় শ্রমিকদেরকেনির্যাতন করার জন্য মাটির অন্ধকারে ইট ভাটার নির্জন স্থানকেই জুলুমের জন্য বেছেনেন মালিক পক্ষ। এরকম কয়েকটি ঘটনা বিভিন্ন পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে, “ নরসিংদীতে ইট ভাটায় আটকে রেখে নির্যাতন”, “ মনিরামপুরে ইট ভাটায় শ্রমিককে শিকল দিয়ে বেঁধে অভিনব নির্যাতন”, “ ইট ভাটার শ্রমিককে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ” এমন শিরোনামের অন্ত নেই।

এছাড়া শ্রমিকরা তার কর্মস্থলেও নিরাপদ নয়। নানাভাবে তাদেরকে জীবন দিতে হচ্ছে। ২০০৫ সালে স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ধসে ৬৩ জনের মৃত্যু, ২০১২ সনের নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১১৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু, ২০১৩ সনের এপ্রিল মাসে রানা প্লাজা ধসে ১১৩৬ জনের মৃত্যুর পরেও মালিকদের শ্রমিক অধিকার বিষয়ে সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কার্যত কোন পদক্ষেপ আলোচনার মতো নয়। অধিকার নিশ্চিতআদায়করতে না পারলেও পুলিশের গুলিতে শ্রমিককে প্রাণ দিতে হয় সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। অথচ দেশের প্রায় শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় তৈরী পোশাক শিল্প শ্রমিকদের মাধ্যমে। আর সেই শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে চলে টালবাহানা।

সম্প্রতি এক বৈঠকে সুইডেন, জার্মান, কানাডা, স্পেন, আমেরিকাসহ ১৪ টি ক্রেতাদেশের রাষ্ট্রদূতরা বিজিএমএ নেতাদের সাথে বৈঠক করে আবারো শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। যেখানে পোশাক শিল্পের সাথে ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত তাদের জীবনই সবচেয়ে বেশী ঝুকিপূর্ণ। বাংলাদেশ কত শ্রমিক পঙ্গু হয়ে কোনভাবে বেঁচে আছেন তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। টাকার অভাবে সুচিকিৎসা হয়না। প্রতি নিয়ত যেন মৃত্যুর প্রহর গুনছে।

মে দিবস পালনের সাথে জড়িয়ে থাকে সচেতনতাবৃদ্ধি, সেবা, পরামর্শ, নির্দেশনাদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দিবস পালনের সফলতা নির্ভর করে নৈতিক আদর্শের উন্নতির উপর। নৈতিকতা ও আদর্শবিহীন দিবস পালন শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। যদি নারী শ্রমিকদের কথা বলি তাহলে দেখবো, বিভিন্ন পেশায় লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিক কাজ করছে কিন্তু তাদের আত্মসম্মান, মূল্যবোধ, ইজ্জত সংরক্ষণের উল্লেখযোগ্য কোন ব্যবস্থা কি আছে ? প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে, কর্মস্থলে ও বিভিন্ন লোক সমাগমস্থলে নারী শ্রমিকরা কোন না কোন ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কেউ কেউ ইজ্জত ও নারীত্ব হারিয়ে বিপদগামী হচ্ছেন। এসবের মূলে মানুষের নৈতিক আদর্শই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। শ্রমিকরা যে তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবেন তাও নির্ভর করে মালিকদের নৈতিক আদর্শের উপর। অনেক সময় শ্রমিক সংগঠনের নেতারা আন্দোলন করেন নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থে। এমন নীতি বর্জন করে সার্বিকভাবে সব শ্রেণির শ্রমিকদের অধিকারের কথা চিন্তা করে কর্মসূচী দেয়া প্রয়োজন।

কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব, আট ঘন্টার অতিরিক্ত শ্রম, এ দেশের শিল্প-কারখানার শ্রমঘন্টা এখন মালিকের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তৈরী পোশাক, চামড়া শিল্পসহ বেশীর ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিক নিয়োগের পরিবর্তে সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে কাজ করানো হয়। মজুরী বোর্ডের ঘোষিত নূন্যতম মজুরী দেয়া হয়না।

নাম মাত্র মজুরী, মূল্যবোধের অভাবসহ নানা অভিযোগ দৃশ্যমান। শ্রমিক হওয়াটাই যেন অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। অথচ প্রত্যেক ব্যক্তিই যে কোন না কোন ভাবে শ্রমিক সে কথা যেন ভুলেই গেছে। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের কথা চিন্তা করে জতীয় কবি নজরুল ইসলাম কুলি মজুর কবিতায় আক্ষেপ করে বলেছেন, “কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে/চোখ ফেটে এল জল/ এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল ?—–দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধীতে হইবে ঋণ ! ” শ্রমিকদের অধিকার ও দাবীকে আলাদা করে না দেখে মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে ন্যায় বিচারের ভিত্তিতেমূল্যায়ন করা প্রয়োজন।শ্রমিকের পর্যাপ্তমজুরী,অগ্নি নিরাপত্তা,কারখানা ও গার্মেন্টসের কাঠামোগত দৃঢ়তা,যৌন হয়রানি বন্ধ, মাতৃত্বকালীন ছুটি, সংশ্লিষ্ট পেশায় শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, নৈতিকতা সম্পর্কে উৎসাহ প্রদান, নিরাপদ কর্মস্থল ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি শ্রমিক-মালিকসহ সকলেরই উত্তম আদর্শ গ্রহণ করা প্রেেয়াজন। ইসলামের শ্রমনীতি অনুসরণ করলে শ্রমিক তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেনা।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট



মন্তব্য চালু নেই