তামিম, এই গল্পটা একটু শুনবেন?

তামিম, আপনাকে একটা ছেলের গল্প বলি। সেদিন ছিল ছেলেটার ছিল সেটা অভিষেক ম্যাচ। অভিষেক! শব্দটা শুনে আপনার মনেও কি রোমাঞ্চ জাগছে না? ২০০৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তারিখটা কখনো ভুলতে পারবেন? আগের রাতে হাবিবুল বাশার যখন আপনাকে বলল, ‘কালকে কিন্তু তু্ই খেলছিস, তোর ডেব্যু…।’ কল্পনা করে নিতে কষ্ট হয় না, কতটা শিহরিত হয়েছিলেন। হারারেতে সেই রাতে একটুও বুঝি ঘুমোতে ইচ্ছে করছিল না। শুধু অপেক্ষা করছিলেন, কখন সকাল হবে, কখন মাঠে নামব!

অভিষেকটা আপনার ভালো হয়নি। কিন্তু কি জানেন, আমি যে ছেলেটার গল্প করছি, তাঁর অভিষেক শুধু খারাপ নয়, হয়েছিল একেবারে জঘন্য। জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হওয়ার ৪৭ সেকেন্ড, হ্যাঁ ৪৭ সেকেন্ডের মাথায় ছেলেটি দেখেছিলেন লাল কার্ড! আপনার মতোই তখন তাঁরও বয়স ছিল ১৮। সেদিন সোজা ড্রেসিংরুমে ফিরে হু হু কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। ছেলেটির নাম? লিওনেল মেসি!
মেসি তাঁর ক্যারিয়ারে আর কখনোই লাল কার্ড দেখেননি। বার্সেলোনার হয়ে ৪১১টি ম্যাচ খেলেছেন, জাতীয় দলের হয়ে ৯৭টি। মেসির নামের পাশে নেই আর কোনো লাল চিহ্ন। হ্যাঁ, হলুদ কার্ড দেখেছেন। কিন্তু ক্লাবের হয়ে ১১ বছরের ক্যারিয়ারে, চার শর বেশি ম্যাচ খেলে দেখা হলুদ কার্ডের সংখ্যা মাত্র ২৬।

শুধু কি তা-ই? মাত্র ১৭ বছর বয়সে বার্সেলোনার মতো এত বড় ক্লাবের হয়ে অভিষেক। পরের বছর আকাশি-সাদা জার্সিতে, ফুটবল উন্মাদনার দেশে, যে দেশে দুবেলা না খেয়ে থাকার কষ্টও মানুষ ভুলে যায় ফুটবলে। আর তাঁর ওপর তো আন্তর্জাতিক প্রচারের আলো আরও আগে থেকে। বলতে গেলে, ১৪-১৫ বছর বয়স থেকেই আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মুখোমুখি হচ্ছেন। দর্শকদের চাপ সামলাচ্ছেন। মিরপুরে কত দর্শকের সামনে খেলেন তামিম? ২০-২২ হাজার? ন্যু ক্যাম্পে দর্শক হয় এক লাখ!

সেই মেসিকে নিয়ে কি সমালোচনা হয় না? গত মৌসুমের শেষের দিকে তাঁকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে কাতালান মিডিয়া। মাদ্রিদের মিডিয়ার তির তো সব সময় তাক করাই থাকে। চ্যাম্পিয়নস লিগে অ্যাটলেটিকোর কাছে হেরে যাওয়ারে পর গ্রাফ এঁকে দেখিয়ে দেওয়া হলো মেসি গোলরক্ষক পিন্টোর চেয়ে কম জায়গা দৌড়েছেন! যেন সবাই ভুলে গেল, এই মানুষটা আগের চার মৌসুমে যা খেলেছেন, সেটা শুধু ভিডিও গেমে খেলা সম্ভব। যে কথা আর্সেন ওয়েঙ্গারের মতো কোচই বলেছেন। এই মানুষটাই প্রায় একাই পাঁচ বছরে চারটা লিগ জিতিয়েছেন। চার বছরে দুটো চ্যাম্পিয়নস লিগ।

আর আর্জেন্টিনায়? মেসি তো যা খেলা শুধু বার্সার জন্য খেলে, গা বাঁচিয়ে। আর্জেন্টিনার ফুটবল সংস্থার তখনকার প্রধান হুলিও গ্রন্দোনার মেয়ে একবার বললেন, ‘মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে খেলার সময় মাঠে এত কম দৌড়ায় কেন?’ অথচ এই মেসি চাইলে স্পেনকেই জাতীয় দল হিসেবে বেছে নিতে পারতেন। সেই ছোট্টটি থাকার সময় স্পেনে চলে এসেছেন। সেখানেই বেড়ে ওঠা। স্পেনের নাগরিকত্বও আছে তাঁর। স্পেনকে বেছে নিলে ২০১০ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য থাকতে পারতেন। ক্লাবের হয়ে যা করেছেন, সঙ্গে একটা বিশ্বকাপ শিরোপা অবিসংবাদিতভাবে তাঁকে সর্বকালের সেরা বানিয়ে দিত।

কিসের টানে আর্জেন্টিনাকে বেছে নিলেন মেসি? কী সেই ভালোবাসা? কী সেই নাড়ির টান? অথচ সেই দেশ তাঁকে গঞ্জনা দিয়েছে। কখনো শুনেছেন মেসি পাল্টা জবাব দিয়েছেন?

সবাই সবার মতো হয় না। প্রত্যেকটা মানুষ তাঁর আঙুলের ছাপের মতোই—ইউনিক, অনন্য। কিছু কিছু মিল থাকে বটে। আপনার সঙ্গে মিল আছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। গত এল ক্লাসিকোতে গোলের পর রোনালদোর উদ্‌যাপন আর পরশু আপনার উদ্‌যাপনের ভাষা এক। রোনালদো অনেকের চোখেই উদ্ধত, অহংকারী। দুর্বিনীত। যে রোনালদো ফার্গির মতো হেডমাস্টারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজের বেতন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। হোসে মরিনহোর মতো বাঘা তেঁতুলও তাঁর সঙ্গে পেরে না উঠে মন্তব্য করেন, ‘ও কারও কথা শোনে না, নিজে যা বোঝে তা-ই করে।’

হ্যাঁ, রোনালদো সে রকমই। মাঠের বাইরেও উদ্দাম। বান্ধবীদের সঙ্গেও সম্পর্কের ব্যাপারে কখনো কখনো সৎ নন। কেবল তাঁর প্রেমিকার লম্বা লিস্টি নিয়ে www.cristianoronaldogirlfriend.com নামের একটা ওয়েবসাইটের হদিসও মিলত। তাঁর ফ্যাশন, তাঁরা স্টাইল—সব সময় আলোচনায়।

এই একই রোনালদো কখনো উল্কি আঁকান না, যেখানে উল্কি ফুটবলারদের নেশা। কেন জানেন, কারণ ট্যাটু আঁকলে আর রক্ত দান করতে পারবেন না! এই রোনালদো নিজের সোনার বুট বেচে গাজার শিশুদের জন্য স্কুল বানিয়ে দেন।

তামিম বলতেই পারেন, হোয়াই অলওয়েজ মি!

এই রোনালদোই মাঠে অবিশ্বাস্য। এই রোনালদো গোল মেশিন। এই রোনালদো ইতিহাসে একমাত্র খেলোয়াড় টানা পাঁচ মৌসুমে শীর্ষ ফুটবলে ৫০টির বেশি গোল করেছেন। মাঠের আলোর উজ্জ্বলতায় মাঠের বাইরের ধূসরতাকে আড়াল করে দিয়েছেন। রোনালদো হতে চাইলে রোনালদোর মতো অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকও হতে হয়। রিয়ালের হয়ে ছয় মৌসুমে ২৯১ ম্যাচে ৩০২ গোল! গড়ে প্রতি ম্যাচেই গোল করেছেন (১.০৩)! লিগে আছে ২৪টা হ্যাটট্রিক!

সেই রোনালদোকে সমালোচনা শুনতে হয় না? সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর গ্যালারিতেই রোনালদোর নামে দুয়ো উঠেছে!
সমর্থকেরা এমনই। যে লুইস ফিগোকে বার্সার সমর্থকেরা মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন, সেই তিনি রিয়ালে নাম লেখাতেই তাঁর দিকে ছুড়ে মারা হয়েছিল শূকরের মাথা! এই একুশ শতকে, মানুষ যখন মহাকাশ জয় করতে চলল, তখনো কালো খেলোয়াড়দের দিকে কেউ কেউ ছুড়ে মারে কলা। কিন্তু এরাই কি সব?

একটা গল্প শুনেছিলাম, সত্যি মিথ্যা জানি না। এক প্রতিবন্ধী দরিদ্র কিশোর, বেয়ারিংয়ের গাড়িতে হাতে ঠেলে চলাফেরা করতে হয়। সে নাকি একদিন বেয়ারিংয়ের গাড়িটা ঠেলতে ঠেলতে আপনাদের জন্য ফুলের মালা নিয়ে এসেছিল। কত নাম না-​জানা সমর্থক আপনাদের খেলার দিন নফল রোজা রাখে, পুজো দেয়, গির্জা-প্যাগোডায় যায়। তাদের ভালোবাসাটা মিথ্যা?

মেসি-রোনালদো? অত দূরেও বা যাওয়ার দরকার কী। মাশরাফির কথা ভাবুন। সাতবার, সা-তবার হাঁটুতে অস্ত্রোপচার হয়েছে। আর একটা হাঁটুর ইনজুরি শেষ করে দিতে পারে ক্যারিয়ারটাই, এমনকি সুস্থভাবে হাঁটাচলা করার ক্ষমতাও। কিন্তু মাশরাফির তাতে পরোয়া নেই। বরং তিনি দলের বাকিদের কাছে এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে চান, দরকার হলে জীবন দিয়ে দেব। দরকার হলে হাঁটুতে ৮ নম্বর অস্ত্রোপচারটাও হবে। দরকার হলে হুইলচেয়ারে বসব। বিশ্বকাপের সময় বলেছিলেন, ‘রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করব।’

এটা স্রেফ কথার কথা না। গত বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলে খেলছেন চড়া মূল্য দিয়ে। কদিন পর পর হাঁটুতে জমা তরল সিরিঞ্জের মোটা সুচ ঢুকিয়ে টেনে বের করে নিতে হয়েছে। প্রত্যেকবার সেই একই কষ্ট! আমি কল্পনায় দেখি, সিরিঞ্জ ঢোকানো হচ্ছে, দাঁতে দাঁত চেপে আছেন মাশরাফি। কিন্তু পারছেন না কষ্ট সইতে। মাগো বলে তীব্র চিৎকার করে উঠছেন।

অন্য কেউ হলে এত দিনে অন্য রাস্তা মাপত। কিন্তু মাশরাফি খেলার আশা ছাড়েন না। বলেন, ‘ক্রিকেটের প্রতি মায়াটা ছাড়তে পারি না যে! আর দেশের জন্য কিছু করার কত বড় সুযোগ এটা। দেশের হয়ে আর খেলব না, এটা ভাবতেই পারি না।’
দেশের কথাও ভাববেন তামিম। দেশের চেয়ে বড় আর কী আছে? দেশটাও যে ‘মা’! প্রথম আলো



মন্তব্য চালু নেই