হয়রানির চক্রে বিএনপি
সিটি নির্বাচনের প্রচারে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা এখনও আবাধে মাঠে নামতে পারছেন না। ‘রাজনৈতিক’ মামলায় জর্জরিত প্রার্থী ও সমর্থকরা ভুগছেন গ্রেফতার আতংকে। এর সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনীর হয়রানি ও বাণিজ্য চক্র। এ ধরনের বাহিনীর অসাধু সদস্যরা প্রার্থীদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে এলাকায় যেতে দিচ্ছেন না। ফলে বাধ্য হয়ে তাদের অনেকেই ‘ম্যানেজ’ করে এলাকায় আসছেন। আবার যারা পারছেন না তারা নানা মাধ্যমে স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন, শুভানুধ্যায়ীদের দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এতেও অনেকে সমস্যায় পড়ছেন। কিছু এলাকায় আত্মীয়স্বজনের পিছু নিয়েছেন আইনশৃংখলা বাহিনীর অসাধু সদস্যরা।
কোথাও কোথাও পুলিশের বিরুদ্ধে উঠেছে আটক বাণিজ্যের অভিযোগ। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের সমর্থক ও আত্মীয়স্বজনকে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও উঠেছে। বিএনপির প্রার্থীর পোস্টার টানানোকে কেন্দ্র করেও পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করতে হচ্ছে। তাদের খুশি করতে না পারলে অনেক এলাকার রাস্তা বা গলিতে পোস্টার টানাতে বাধা দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রথম দিকে এসব বিষয়ে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলেও পরে পুলিশি হয়রানি বা আটকের আশংকায় অনেকেই প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাননি। কিন্তু এখন তাদের সেই ভয়ের বাঁধ প্রায় ভেঙে গেছে। ফলে রোববার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে প্রার্থীদের মতবিনিময়ের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনের সামনেই পুলিশি হয়রানিসহ নানা ধরনের অভিযোগ করলেন অনেক প্রার্থী। এ ব্যাপারে তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
প্রার্থীদের হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেন, কেউ যেন অযথা হয়রানির শিকার না হয় এবং প্রার্থীরা যাতে সুন্দরভাবে প্রচারণা চালাতে পারেন সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে আইনশৃংখলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জনগণ যাতে নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন সে পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্যও তাদের নির্দেশ দেয়া হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর কোনো সদস্য কোনো প্রার্থী বা তার কর্মীদের হয়রানি করছে না। বিএনপি সমর্থিত কোনো প্রার্থী বা তাদের নেতাকর্মীদের নির্বাচনী পোস্টার টানানো, জনসংযোগ বা অন্য যে কোনো ধরনের প্রচারণার কাজে বাধা দেয়া কিংবা হয়রানি করা হচ্ছে না। আদালতের পরোয়ানাভুক্ত কোনো পালাতক আসামি থাকলে শুধু তাদের ক্ষেত্রেই পুলিশ আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো প্রার্থীর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে আমাকে জানান। ঘটনার এক বিন্দু সত্যতা থাকলেও আমি সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।
রোববার ঢাকা উত্তরের মেয়র ও কাউন্সিল প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন নির্বাচন কমিশন। সেখানেও প্রার্থীরাও অভিযোগ করেন পুলিশ তাদের নানাভাবে হয়রানি করছে। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল সিইসির কাছে অভিযোগ করেন, ২০ দলীয় জোট ও আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের অনেক কর্মী পুলিশের হয়রানির ভয়ে আÍগোপনে আছেন বলে অভিযোগ করেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাসদ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আবদুল্লাহ আল ক্বাফী পুলিশ হয়রানির বিষয়ে বলেন, মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর গত ২৮ মার্চ রাত ৩টার দিকে পুলিশের একটি দল তার নাখালপাড়ার বাসা খুঁজতে আসে। পুলিশ সদস্যরা আশপাশের লোকজনের কাছে ক্বাফীর বাসা চিনিয়ে দিতে বলে এবং কী কারণে নির্বাচন করছি তা জানতে চায়। তবে এলাকাবাসী পুলিশ সদস্যদের আমার বাসা চিনিয়ে না দেয়ায় তারা চলে যায়। এ ঘটনায় এলাকায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে বলে জানান ক্বাফী। এ মেয়র প্রার্থী বলেন, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই তাদের যেন পুলিশ প্রশাসন হয়রানি না করে সে অনুরোধ জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়ার কাছে।
ক্যান্টনমেন্ট এলাকার কাউন্সিলর প্রার্থী আব্বাস উদ্দিন সিইসির সামনে অভিযোগ করে বলেন, যেসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা নেই পুলিশ তাদেরও হয়রানি করছে। আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকা সত্ত্বেও মনোনয়নপত্র কেনার পর পুলিশ আমাকে আটক করেছিল। পুলিশের ভয়ে আমি মাঠে নামতে পারছি না।
প্রার্থীদের হয়রানি ও আটক বাণিজ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে পল্লবী থানার ওসি সৈয়দ জিয়াউজ্জামান বলেন, নির্বাচনের প্রার্থী বা সমর্থকদের হয়রানির কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, যারা চিহ্নিত সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী পুলিশ তাদের আটক করছে। কিন্তু কোনো মামলা বা অভিযোগ নেই এমন ব্যক্তিদের হয়রানি করা হচ্ছে না।
সংরক্ষিত নারী আসনের প্রার্থী পেয়ারা মোস্তফা অভিযোগ করেন, শনিবার নির্বাচনী প্রচার শেষে মহাখালী থেকে তার এক কর্মীকে বনানী থানায় আটক করা হয়। পরে কয়েক ঘণ্টা চেষ্টার পর তাকে ছাড়িয়ে আনা সম্ভব হয়। সাধারণ আসনের কাউন্সিলর প্রার্থী তুষার আহমেদ বলেন, ‘বাসা থেকে পালিয়ে মতবিনিময় সভায় এসেছি। ঘর থেকে বের হতে পারছি না। ছেলেমেয়েকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। জীবন বাঁচাব না নির্বাচন করব।
নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসলে সংশ্লিষ্ট দোষীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতিমধ্যে সিইসি কাউকে হয়রানি রা করার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তের পর দলের নেতাকর্মীদের ধারণা ছিল পুলিশ তাদের আর হয়রানি বা আটক করবে না। এমন বিশ্বাসে অনেকেই আত্মগোপন থেকে এলাকায় আসতে শুরু করেন। কিন্তু তারা প্রকাশ্যে এসেই বুঝতে পারেন অবস্থা পাল্টায়নি। তারা প্রকাশ্যে এসে নির্বাচনী প্রচারের প্রস্তুতি শুরু করলেই পুলিশ তাদের পিছু নিচ্ছে। প্রতি রাতেই নেতাকর্মীদের বাসায় গিয়ে হানা দিচ্ছে পুলিশ। আটকের ভয় দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে অনেককে ছেড়েও দিচ্ছে।
রাজধানীর শেরেবাংলানগর এলাকায় বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর অন্যতম সমন্বয়ক শাহীনকে (ছদ্মনাম) শুক্রবার রাতে আটক করা হয়। রাতে টহল পুলিশ তাকে আটক করে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়ার ভয় দেখান। পরে থানা বিএনপির এক নেতার সঙ্গে কথা বলেন শাহীন। পুলিশকে ম্যানেজ করা সম্ভব হলে তাকে ছেড়ে দেবে বলে জানান তিনি। শাহীন গ্রেফতার হলে ওই কাউন্সিলর প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারে সমস্যা হবে বুঝতে পেরে তিনি শাহীনকে ছাড়ানোর জন্য তদবির শুরু করেন। নানা মাধ্যমে দেন দরবার করে পরে টাকার বিনিময়ে শাহীন ছাড়া পান। শেরেবাংলা নগর থানার ওসি জিজি বিশ্বাস এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনী প্রচার এখনও জমেনি। আমার থানা এলাকায় কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। আর আটক বাণিজ্যের তো প্রশ্নই ওঠে না।
জানা গেছে, রাজধানীর বংশাল থানা এলাকায় প্রতি রাতেই বিএনপি নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় গিয়ে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। কারও হাতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর লিফলেট দেখলেও হুমকি দেয়া হচ্ছে। কয়েকদিন আগে হান্নান নামে বিএনপির এক কর্মীকে ধরে ডিসির কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার দেখানো হবে এমন নানা ভয়ভীতি দেখায়। বিষয়টি স্থানীয় বিএনপির এক নেতাকে জানানোর পর তিনি তদবির শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত সমঝোতা করে তিনি ছাড়া পান।
সূত্র জানায়, বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম ৭ এপ্রিল কারাগার থেকে মুক্তি পান। কারগারের মূল গেট থেকে বেরোনোর পর সাদা পোশাকে পুলিশ পরিচয়ে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার যাতে কোনো মামলায় গ্রেফতার না দেখানো হয় এ জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে তদবির করেন শামীম। নানা মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীকে ম্যানেজ করে রাতে ছাড়া পান তিনি। আবার কয়েকদিন আগে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য বেলাল আহমেদ জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর কারাফটক থেকে আটক হন। কিন্তু তিনি চেষ্টা করেও পার হতে পারেননি। অন্য মামলায় তাকে আটক দেখানো হয়।
সূত্র জানায়, ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ এক নেতা সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পান। কারাফটকে আবার পুলিশ আটক করতে পারে এমন আশংকায় আগে থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেন তিনি। ওই নেতা তার আত্মীয়-স্বজনকে কারাফটকে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ম্যানেজ করার নির্দেশ দেন। কারাফটকে যেন আবার আটক না হন এমন শর্তে পুলিশের সঙ্গে সমঝোতা হয়। কারাগার থেকে বেরিয়ে ওই নেতা যুগান্তরকে বলেন, মামলায় জামিন নিতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে তার চেয়ে বেশি টাকা লাগল শুধু কারাফটকের সামনে পুলিশকে ম্যানেজ করতে।
সূত্র জানায়, কোথাও কোথাও আটকের পর সমঝোতায় আসতে না পারলে তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠয়ে দেয়া হচ্ছে। ২২নং ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি মো. আলীকে শনিবার আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। আটকের খবর পেয়ে আলীর আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয় নেতারা তাকে ছাড়াতে দেন-দরবার শুরু করেন। কিন্তু সমঝোতা না হওয়ায় পরে মো. আলীকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়।
বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা অভিযোগ করেন, শুধু নেতাকর্মীদের আটক করেই থেমে নেই পুলিশ। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের ব্যানার-পোস্টার টানানো নিয়েও চলছে বাণিজ্য। পুলিশকে খুশি করতে না পারলে অলি-গলিতে কোনো পোস্টার টানাতে দিচ্ছে না। শনিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে আজিমপুরে এক গলিতে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে কয়েকজন পোস্টার টানানোর প্রস্তুতি নেন। এমন সময় টহল পুলিশ এসে তাদের কাছে জানতে চান কোন দলের প্রার্থী। বিএনপি সমর্থিত শুনেই তারা গাড়ি থেকে নেমে পোস্টার টানানো যাবে না বলে বাধা দেন। পরে বিষয়টি স্থানীয় বিএনপির এক নেতাকে জানায় পোস্টার টানাতে আসা লোকজন। কিছুক্ষণ পর পুলিশের গাড়ি চলে যায়। জানতে চাইলে পোস্টার টানানোর সময় থাকা একজন বলেন, ‘ভাই বুঝতেই তো পারছেন।’
‘আদর্শ ঢাকা আন্দোলন’-এর সদস্য সচিব শওকত মাহমুদ এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, এখনও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হয়নি।
বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এবং নেতাকর্মীদের পুলিশ নানাভাবে হয়রানি করছে। অনেককে আটকও করা হচ্ছে। প্রতিনিয়তই এমন অভিযোগ পাচ্ছি। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ইতিপূর্বে নির্বাচন কমিশনের কাছে আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু কোনো উদ্যোগ দেখছি না। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় আইনশৃংখলা বাহিনী নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে যায়। নির্বাচন কমিশন প্রার্থী ও সমর্থকদের হয়রানি না করতে আইনশৃংখলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে শুনেছি। এখন দেখি তাদের নির্দেশে কাজ হয় কিনা। এ ব্যাপারে আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্মকাণ্ডও আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। যুগান্তর
মন্তব্য চালু নেই