চাঁদপুরে লেংটার মাজারে ওরসের নামে নেশার আস্তানা

চাঁদপুরের মতলব উত্তর বদরপুর (বেলতলী) গ্রামে সোলেমান লেংটার মাজারে ৯৬তম ওরস ও মেলা শুরু হচ্ছে। শুরুর আগেই ইতোমধ্যে আশপাশে পাগল ও নেশাখোরদের আস্তানা বসে গেছে। চলছে অশ্লীলতা, অবাধে মাদক বিক্রি ও সেবন।

মঙ্গলবার থেকে সাতদিনব্যাপী চলার কথা হলেও থাকে প্রায় মাসবাপী।

এ উপলক্ষে মাদক বিক্রি, জায়গা ভাড়া ও মাজারের দানের নামে চলছে কোটি-কোটি টাকার বাণিজ্য। এ বিষয়গুলো নিয়ে প্রশাসনের রয়েছে নিশ্চুপ।

সোমবার সকালে মাজার প্রাঙ্গণে মিলাদ ও দোয়ার মাধ্যমে ওরস শরীফের উদ্বোধন করা হয়। মাজার কমিটির সভাপতি সিনিয়র সহকারী সচিব আলহাজ এসএম আবদুর রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক আলহাজ এসএম সৈয়দ হোসেন, সহ-সভাপতি আশরাফুল ইসলামসহ এলাকার বিশিষ্টজন, ভক্ত-আশেকানরা উপস্থিত ছিলেন।

সোলেমান লেংটা উপমহাদেশের একজন খ্যাতিমান আউলিয়ার দাবিদার। বাংলা ১২৩০ সালে কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার গোবিনাদপুর ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে শাহ্ সুফি সোলেমান লেংটা জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আলা বক্স ভূঁইয়া। তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন মতলবের বিভিন্ন অঞ্চলে। সোলেমান লেংটা কখনো পোশাক পরিধান করতেন না। তাই তার মাজারটি লেংটার মাজার হিসাবেই পরিচিত।

লেংটা ১৮ বছর বয়সে প্রেম করে বিয়ে করেন। পরে নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলির রাধানগরে এক নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এখন সেখানে তার আওলাদরা আছে বলে দাবি উঠেছে এবং তারা প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময় ওরসের ডাক দিচ্ছে।

শাহ্ সুফি সোলেমান লেংটার ফকিরি লাভ সম্পর্কে জানা যায়, ইমাম উদ্দিন মিয়ারা ছিল তিন ভাই। তিন ভাই নৌকা করে ভাদ্র মাসের এক অমাবস্যা রাতে সোনারগাঁয়ে তাদের পীরের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। নৌকার মাঝি ছিলেন সোলেমান শাহ। পথিমধ্যে বৃষ্টি হয়, তিন ভাই আরাম করে নৌকার ভেতর। সোলেমান শাহ ভিজে ভিজে নৌকা চালায় এবং গন্তব্যে হাজির হয়ে যায়।

নির্দিষ্ট সময় পীর আসে এবং এ দৃশ্য দেখে রাগ হয়। পীর তখন তিন ভাইকে উলঙ্গ হয়ে আসতে বলে। তিন ভাই চিন্তায় পড়ে যায়। আপন মায়ের পেটের তিন ভাই কীভাবে উলঙ্গ হবে একে অপরের সামনে আসবে। পীর সাহেব মাঝি সোলেমানকে উদ্দেশ্য করে কাছে আসতে বলে। সোলেমান কাছে যায়। পীর তাকে হা করতে বলেন এবং মুখে ফুঁক দেয়। সেখান থেকেই সোলেমান লেংটা হয়ে বাড়ি ফিরে।

নেশার আস্তানা২সোলেমান লেংটার অনেক অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। তার মধ্যে সোলেমান লেংটা কালিপুর রমিজ উদ্দিন প্রধানীয়ার বাড়িতে যান। দেখেন নারীরা নদী থেকে ঘট পুড়িয়ে ঘর, উঠান লেপছে। তিনি তাদের পানি আনার কষ্ট দেখে তাদের চোখ বন্ধ করতে বলেন। তারা চোখ বন্ধ করলে লেংটা তার নফস টেনে প্রায় ২/৩ হাত লম্বা করে পুরো উঠান পানিতে ভিজিয়ে দেয়। এ ঘটনা তিনি বিভিন্ন গ্রামে করেছেন।

এক সময় মানুষ হজে যেত জাহাজে কিংবা পায়ে হেঁটে। অনেক দিন লাগতো, হজে যাওয়ার সময় অনেকেই লেংটাকে বদরপুর দেখে গেছে, হজ পালন করার সময় অনেকেই তাকে কাবা শরীফে দেখেছেন নামাজ আদায় করতে। এমন অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা লোকমুখে প্রচলিত।

সোলেমান লেংটার বোনের বাড়ি বদরপুরে মাজারটি অবস্থিত। ১৩২৫ বাংলা সনের ১৭ চৈত্র শাহ্ সুফি সোলেমান লেংটা তার বোনের বাড়ি বদরপুর গ্রামে মৃত্যুবরণ করলে সেখানে কবর দিয়ে মাজার স্থাপন করা হয়। প্রতি বছর চৈত্র মাসের ১৭ তারিখে তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ৭ দিনব্যাপী ওরস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং মেলা বসে। ওরস শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে ও পর পর্যন্ত মেলা স্থায়ী হয়। সোলেমান লেংটার মাজার02এছাড়া প্রতিবছর ভাদ্র মাসে ও প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার মাজারে ভক্তদের আগমন ঘটে। চৈত্র মাসের ১৭ তারিখের মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থানসহ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক ভক্ত, আশেকান ও সাধারণ জনগণ আসা যাওয়া করেন। ওরসকে কেন্দ্র করে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে মেলায় বসে রকমারি দোকান ও বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ভক্তদের আস্তানা। মেলায় চলে বিভিন্ন প্রকার পণ্য ক্রয়- বিক্রয় হয়। কেউ কেউ মাদক ও অশ্লীলতার মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে।

৭ দিনের এ মেলায় আসা দোকান থেকে ২ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। মাজারে মানত মানতে দেয়া হচ্ছে গরু, ছাগল, নগদ অর্থ, আগরবাতি ও মোমবাতি। প্রতিদিন উঠছে কোটি টাকা। সব মিলে এখানে বাণিজ্য হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা। এ টাকার কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার। অনেকেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনছেন। সারা বছর এ মাজারটি অর্থ পাওয়ার সেক্টরে পরিণত হয়েছে। টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষ ও মামলা হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতি বছরের মতো এখানে মেলা শুরুর আগেই চলছে মাদক বিক্রি, সেবন ও অশ্লীলতা। মেলার শুরুর আগেই নেশাখোর মাজারের চারপাশে প্রায় ৫ শতাধিক আস্তানা গেরে বসেছে। জানা যায়, সব প্রকার মাদকদ্রব্যই পাওয়া যায় এ মেলায়। নেশাখোরদের দেখলেই মনে হয় মেলা প্রাঙ্গণ যেন নেশার স্বর্গরাজ্য ও নিরাপদ স্থান। দলে দলে আস্তানা বেঁধে সেবন করছে মাদকদ্রব্য। মেলা প্রাঙ্গণের বাতাসে বইছে গাঁজার গন্ধ। লেংটার মেলাকে গঞ্জিকাসেবীদের মেলা হিসেবে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। পুলিশ এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে গেলেও মনে হয়েছে অবস্থার প্রেক্ষিতে তারা নিরুৎসাহিত।

মতলব উত্তর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, মেলায় লাখ লাখ লোকের সমাগম হয়। মেলায় সব ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তিনি মেলায় মাদক বিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকার কথা জানান।



মন্তব্য চালু নেই