কার স্বার্থ দেখছে বিটিআরসি?
সরকারের ৫শ কোটি টাকা লোকাসানের পরও নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। মোবাইল, আইসিএক্সের (ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ) এর মতো টেলিকম কোম্পানি ও অভ্যন্তরীণ অনেক কর্মকর্তার বিরোধিতা সত্ত্বেও বিদেশ থেকে আসা টেলিফোন কলের হ্রাসকৃত রেট (আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল টার্মিনেশন রেট) বহাল রেখেছে কমিশন।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, নিজেদের ক্ষতি করে শুধু আন্তর্জাতিক গেটওয়ে কোম্পানির (আইজিডব্লিউ) স্বার্থেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কারণ অধিকাংশ আইজিডব্লিউ এর মালিকানায় ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্টদের অংশীদারিত্ব রয়েছে।
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক কল রেট অর্ধেকে নামিয়ে আনে বিটিআরসি। একই সঙ্গে সরকারের কমিশন হারও কমানো হয়। এ সিদ্ধান্ত ৬ মাসের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। মঙ্গলবার ছয় মাসের সময়সীমা শেষ হচ্ছে।
শেষদিনের একদিন আগেই সোমবার এক নির্দেশনায় বিটিআরসি জানায়, পরবর্তী নোটিশ না দেয়া পর্যন্ত পরীক্ষামূলক কলরেটই বহাল থাকবে। বিটিআরসির পরিচালক (সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিস ) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জুলফিকার স্বাক্ষরিত এ চিঠি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানো হয়েছে। অবশ্য এতে সরকারেরও সায় রয়েছে। কারণ এ নির্দেশনা জারির আগে বিটিআরসি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়েছে।
কলরেট কমানোর সময় বলা হয়েছিল, এর ফলে অবৈধ পথে কল আদান-প্রদান কমে যাবে। একই সঙ্গে রাজস্ব আয়ও বাড়বে। ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আয় বাড়বে বলে সরকারকে বুঝিয়েছিল বিটিআরসি।
কিন্তু পরে দেখা গেল, রেট কামনোর ফলে বৈধ পথে আন্তর্জাতিক কলের আসা-যাওয়া বাড়লেও সরকারের রাজস্ব, আইসিএক্স ও মোবাইল বা ল্যান্ড ফোন কোম্পানিগুলোর আয় কমে গেছে। শুধু আইজিডব্লিউগুলোর লাভ বেড়েছে।
বিটিআরসির সূত্র জানিয়েছে, নতুন করে সময়সীসা বাড়ানোর বিপক্ষে অনেক কর্মকর্তা মত দিলেও শুধু একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজদের স্বার্থেই মেয়াদ বর্ধিত করা হলো।
বিটিআরসির তথ্য মতে, গত বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের তুলনায় সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বৈধ পথে কল আসার পরিমাণ ৮৫৭ কোটি ৬০ লাখ বেড়েছে।
অথচ গত সেপ্টম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫ মাসে আন্তর্জাতিক কল রেট থেকে বিটিআরসির রাজস্ব কমেছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। মার্চ পর্যন্ত এর পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকায় পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ খাতে বিটিআরসির রাজস্ব আয় ছিল ১ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। সেখানে গত সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আয় করেছে মাত্র ৬৬৮ কোটি টাকা।
একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশনের সঙ্গে জড়িত আইসিএক্স ও মোবাইল কোম্পানিগুলোর আয়ও কমেছে। এ নিয়ে নিজেদের উদ্বেগ জানিয়ে চলতি সপ্তাহে বিটিআরসিতে চিঠিও দিয়েছে মোবাইল কোম্পানিগুলোর সংগঠন অ্যামটব। তারা কলরেট পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে।
অপরদিকে কলরেট কমানোতে লাভ করেছে আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানগুলো। সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোম্পানিগুলো ৫২ কোটি টাকার উপরে লাভ করেছে।
আগে প্রতি কল তিন সেন্টে (২ টাকা ৩২ পয়সা) দেশে আসতো। হ্রাসকৃত রেটে এর মূল্য হয়েছে দেড় সেন্ট। আগে প্রতি কল থেকে সরকার রাজস্ব পেত ৫১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। নতুন সিদ্ধান্তে সরকার পায় ৪০ শতাংশ। আর এর ফলে আইজিডব্লিউয়ের মুনাফা ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয় ২০ শতাংশ। বাকি অর্থ আইসিএক্স এবং যে মোবাইল বা ল্যান্ডফোনে কলটি যায় তারা ভাগ করে নেয়।
উল্লেখ্য, কোনো ধরনের যৌক্তিকতা ছাড়াই ২০১২ সালে ২৪ প্রতিষ্ঠানকে আইজিডব্লিউ লাইসেন্স দেয়া হয়। যার অধিকাংশ ছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়। অনেক আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারি দলের সংসদ সদস্য, নেতা বা তাদের আত্মীয় স্বজন জড়িত। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এগুলোর অনেক প্রতিষ্ঠান সরকারের পাওনা পরিশোধ করছে না। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিটিআরসির হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এরপরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে কলরেট কমিয়ে উল্টো অতিরিক্ত মুনাফার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মন্তব্য চালু নেই