খোঁজ দ্য সেক্স (১৮ +)
অমিতাভ চক্রবর্তীর নাম আমি এর আগে শুনিনি। পৃথিবীতে অনেকের নামই শুনিনি। ফলে কারও নাম শোনাটা খুব গুরুত্বের বিষয়না। পৃথিবীর সব কিছুর নাম এক জীবনের জানা সম্ভব না। তো ‘কসমিক সেক্স’ সিনেমাটা দেখার পর জানলাম এর পরিচালক তিনি। এর আগেও এমনটা হয়েছে, যেমন ‘স্প্রিং সামার ফল উইন্টার… অ্যান্ড স্প্রিং’ সিনেমাটা দেখার পর জেনেছি এর পরিচালক কিম কি দুক। সে যাহোক, কসমিক সেক্স একটা ইনডিপেনডেন্ট সিনেমা। মানে বাজারি সিনেমার চোখ দিয়ে এ সিনেমা দেখা যাবে, কিন্তু বিশ্লেষণ করা যাবেনা।
প্রথমত সিনেমা সম্পর্কে আমার জানাশোনা একেবারেই নাই। দ্বিতীয়ত ইনডিপেনডেন্ট সিনেমা সম্পর্কে জানাশোনা আরো নাই। আমার যে বাড়িতে জন্ম, মানে যে ঘরে আমি বড় হয়েছি, সেই ঘরের দরজায় দাঁড়ালে সিনেমা হল দেখা যেত। মাঝখানে ছিল ছোটো একটা ফসলের মাঠ। আমাদের বাড়িতে কোনো টিভি ছিলনা। এখনও নাই। মানে টিভি দেখা নিষেধ। এরপরও টিভি দেখেছি। টিভি দেখার কারণে বাবার হাতে মারও খেয়েছি। টিনের বেড়া দেওয়া সিনেমা হলের ফুটোর মধ্যে দিয়ে সিনেমা দেখেছি বহুবার। পাড়ার ছেলে বলে মাস্তানি করে বিনা টিকিটে বা পরে টিকেট কেটেও সিনেমা দেখেছি। এর মানে বাজারি সিনেমা দেখে-দেখে বড় হয়েছি। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক কুমার ঘটক, মৃণাল সেনের নাম শুনেছি অনেক পরে। এদের দুয়েকটা সিনেমাও দেখেছি। সারা দুনিয়া জুড়ে যে স্বতন্ত্র ফিল্ম বা নতুন ফিল্মের আন্দোলন চলছে, তা আমার জানাশোনার বাইরে।
কসমিক সেক্স দেখে খটকা লাগতে পারে, যেমনটা লেগেছিল মনের মানুষ দেখে, বাউলরা কি কামসর্বস্ব? মনের মানুষ দেখে অনেকে এমন প্রশ্নযুক্ত স্ট্যাটাস ফেসবুকে দিয়েছিলেন, সেটা ভেবেই এ কথা বলা। যারা এর আগে এমন প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাদের সেই বিশ্বাস পোক্ত হতে পারে এই সিনেমা দেখার পর। তাই যারা সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন তাদের আগেই বলে রাখি এটা বাণিজ্যিক সিনেমা না। কেউ আবার বলতে পারেন, ইনডিপেনডেন্ট সিনেমা কি ধোয়া তুলসি পাতা? কোনো প্রশ্ন তোলা যাবেনা? অবশ্যই তোলা যাবে। আদতে ইনডিপেনডেন্ট হলেও সিনেমা হলো কিনা সেটা যাচাই করা যেতেই পারে।
আঠার বছরের কৃপা। এই সিনেমার নায়ক। সে প্রথমে তার বাবাকে খুন করে। পরে এক হিজড়াকে খুন করে। সেখান থেকে পালাতে গিয়ে আশ্রয় নেয় সাধনা মা নামের এক তাত্ত্বিক বাউলের কাছে। সাধনাকে দেখতে ঠিক তার মায়ের মতো। সেও তাকে মা ডাকে। সাধনা তাকে দেহের ভেতর দিয়ে মানে সেক্সের ভেতর দিয়ে মানে কামের ভেতর দিয়ে নিষ্কামে পৌঁছার পথ শেখায়। এখানে কাহিনী ফ্ল্যাশ ব্যাকে চলে যায়, সাধনার বড় হওয়া, তার গুরুর কাছ থেকে তত্ত্ব শেখা, গুরুর স্ত্রীর মৃত্যু, গুরুর মৃত্যু এ সব দেখানো হয়। কৃপা জানতে পারে তাঁর বাবা বেঁচে আছে, হিজড়াও মরেনি। সে বাবাকে ফোন করে। হিজড়াও চলে আসে। কৃপা ও সাধনা যেতে চায় গ্রামে। তার বাবা পালিয়ে যায়। হিজড়া বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সে তাদের পিছু নেয়। নদীর পারে গিয়ে সাধনাকে ছুরিকাঘাত করে হিজড়ার এক সহযোগী। এই হলো কাহিনী।
এই সিনেমা শুরুর দিকের কাহিনীটা আমার কাছে বাণিজ্যিক ধাঁচের মনে হয়েছে। বিশেষ করে, ক্রাইম বা ভায়োলেন্স প্রবণতার কারণে এটা হয়ে থাকতে পারে। সিনেমা গুরু নুরুল আলম আতিক বলেছিলেন, হলিউডি সিনেমার প্রধান রস ভায়োলেন্স আর সেক্স (হুবহু মনে নাই)। এই সিনেমার শুরু এবং শেষে সেটা প্রকট। তবে পরে বলা হয়েছে, কামের কারণেই মানুষ নানা রকম অপকর্ম ঘটায়। কাম যে নানারকম অনর্থের মূল এটা তারই ইঙ্গিত করে। সিনেমায় কাম থাকলেও তা নিষ্কামের পথঅনুসারী।
সেক্সকে বাউলের তাত্ত্বিক দৃষ্টি থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একই সঙ্গে তা প্র্যাকটিকাল দেখানো হয়েছে। একটা গান আছে, ‘মাই হে, কলঙ্কিনী রাধা, কদম গাছে উঠিয়া আছে কানু হারামজাদা। মাইহে তয় জলে না যাইও।’ এই গানের কানু হলো সিনেমার সেক্স। সে সবসময় মানুষ নামের রাধাদের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, কদম গাছে উঠে থাকে। ফলে জলে না যাওয়াটাই বেটার। তবে কানুর বশ না হয়েও কি করে জলে যেতে হয় মানে জীবনযাপন করা যায়, সিনেমায় তাই হলো দ্রষ্টব্য।
ফকিরি দর্শনে (বাউলের একটা শাখা) আছে, দেহের মধ্যে ঈশ্বর আছেন। সৃষ্টির সময় যে বস্তু ধারণ করে জন্ম হলো তা হলো আমি। কিন্তু সেই মূলের আমি ক্রমাগত রূপান্তরে স্থুল স্থুল হতে হতে দূরে চলে গেছে। তো আমি তথা দেহের সাধনা করে মূলের আমি তথা ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন হলোই সাধনার সার কথা। এই সাধনার পথে বাঁধা হলো কাম। সংসারি মানুষ কামের ফাঁদে বন্দি। কামই মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হতে বাঁধা দেয়। আবার কাম ছাড়াও মানুষ হওয়া যায়না। কারণ, কাম হচ্ছে শক্তি। শক্তির ধ্বংস হয়না। তবে রূপান্তর হয়। কামকে প্রেমে রূপান্তর করাটাই মূলকথা। সেটাই সাধনার সিদ্ধি। কিন্তু এ পথ খুব কঠিন। সেই কঠিন পথেই হেঁটেছে সিনেমার নায়ক কৃপা।
কৃপা প্রথমে সেক্স খুঁজেছে। সেটা পূরণ করতে না পেরে তার মনে অন্য রিপুগুলো সক্রিয় হয়েছে। সে বাবাকেও খুন করতে পিছপা হয়নি। সেখান থেকে সে গুরু ধরে নিষ্কামের চর্চা করেছে। এই চর্চা যে গুরু ছাড়া সম্ভব না এটাও ঠিক। হাজার বছর ধরে সহজিয়ারা গুরুপরম্পরায় সাধনা করে আসছে। এটাকে অস্বীকারের কোনো উপায় নাই।
সত্যি কি সিনেমাটা সেক্সের পথ বাতলে দেয়? কসমিক শব্দটার অর্থ মহাজাগতিক। মহাজাগতিক মানে কি? জগতের মধ্যে অসীম জগত। দেহের মধ্যে যেমন দেহাতীত আত্মা। তাই কসমিক সেক্স কেবল সেক্সের খোঁজ না, কেবল ফকিরি ফিলোসফি না, এ হলো জীবনের পথ, খোঁজ দ্য লাইফ। এখানেই আর্ট হিসেবে কসমিক সেক্সের সাফল্য। চিয়ার্স, অমিতাভ চক্রবর্তী।
যে কথা না বললেও চলে: সিনেমাটা অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। এডাল্ট দৃশ্য আছে। তবে এটা পর্ন না। মানে সেই দৃশ্যগুলোকে রগরগে বা অশ্লীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়নি। ঢাকার অভিজাত সিডি দোকানগুলোতে এটা পাওয়া যায়। ইউটিউবেও দেখা যায়। এ ছাড়া কসমিক সেক্স নামে ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও দেখা সম্ভব। এই সিনেমায় অভিনয় করে নায়িকা চরিত্রের ঋ সেন ওসিয়ান’স সিনেফান (আরব ও এশিয়ার সিনেমা ফেস্টিভ্যাল) সেরা অভিনেত্রির পুরষ্কার জিতেছেন।
মন্তব্য চালু নেই