ঐতিহ্যবাহী আফগান কার্পেট শিল্প
মুসলিম চিত্রকলার সর্বশেষ দীর্ঘস্থায়ী নিদর্শন কার্পেট। মধ্যযুগে মুসলিম চিত্রকলার ব্যাপক উৎকর্ষ হলেও কালের বিবর্তনে তা এখন ধূসর প্রায়। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা চিত্রকলার প্রভাবে দেশ ভেদে চিত্রকলায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। তারপরেও এশিয়ার দেশ ইরান এবং আফগানিস্তান মুসলিম চিত্রকলাকে এখনও ধারন করে আছে। ইরানের বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলী এবং পোশাকশিল্পে এই চিত্রকলার প্রভাব আজও দেখা যায়। একই সঙ্গে যুদ্ধবিদ্বস্ত দেশ আফগানিস্তানের স্থানীয়রা এখনও কার্পেট তৈরিতে সেই আদি কলাকে উপজীব্য করেই কার্পেট শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক কিছু ঐতিহাসিকের মতে, কার্পেটে মুসলিম চিত্রকলার প্রভাব সর্বপ্রথম দেখা যায় আফগানিস্তান ও বর্তমান উজবেকিস্তানে। পরবর্তী সময়ে ইরান এই শিল্পে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করে। তবে বর্তমানে আজারবাইজান, তুরস্কতেও ভালো কার্পেট তৈরি করা হয়।
আফগানিস্তানের যাযাবর আদিবাসী গোষ্ঠিগুলো নিজেদের প্রয়োজনে বা ব্যবহারের জন্য এই কার্পেট তৈরি করতো। কার্পেট বুননে পুরুষেরা কাজ করলেও নকশাকারক হিসেবে কাজ করেন আফগান নারীরা। বংশ পরম্পরায় এই নকশা বয়ে বেড়ায় আফগান নারীরা। ভেড়ার পশম দিয়ে তৈরি একটি কার্পেট তৈরিতে নিদেনপক্ষে কয়েক মাস সময় লেগে যায় এর নকশাকারকদের। প্রথমত, বুনন শেষ করার পর রং করা থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়াটা খুব যত্নের সঙ্গে করতে হয়। একটু যত্নের ঘাটতি হলে কমে যেতে পারে কার্পেটটির স্থায়িত্ব।
বর্তমানে যদিও যন্ত্রের সহায়তায় অনেক দেশই কার্পেট তৈরি করছে। কিন্তু যন্ত্রে বানানো কার্পেটের তুলনায় হাতে বানানো কার্পেটের কদর অনেক বেশি। আফগানিস্তান প্রতিবছর ২৩১ মিলিয়ন ডলারের কার্পেট রপ্তানি করে অন্যান্য দেশে। তবে দুঃখজনক কথা হলো, এই অর্থের খুবই সীমিত একটি অংশ ওই যাযাবর আদিবাসী গোষ্ঠির হাতে পৌছায়, যারা দিনের পর দিন কষ্ট করে ওই কার্পেট তৈরি করেছে। কিন্তু আফগান যাযাবরেরা কিছু কার্পেট তৈরি করে শুধুই নিজেদের জন্য। এই কার্পেটগুলো তারা বিক্রির জন্য তৈরি করে না। পশতুন ভাষায় এই বিশেষ কার্পেটগুলোকে বলা হয় ‘হাচলো’। তাবুতে ঢোকার মুখেই একটি নির্দিষ্ট স্থানে এই কার্পেটটি তৈরি করার আফগান রীতি অনেক প্রাচীন। আফগানদের রীতি অনুযায়ী যাদের তাবুর বাইরে এরকম কার্পেট তৈরি করার হয় বছরের সবসময়, তাদের ঘরে বছরব্যাপী শান্তি বিরাজ করে। তবে বিক্রির জন্য এই কার্পেটগুলো তৈরি না হলেও বিয়ে বা বিশেষ কোনো অতিথিকে দেয়ার রেওয়াজও আছে এই গোষ্ঠিগুলোতে। যাযাবররা মূলত কার্পেটগুলো বিক্রির বিনিময়ে নগদ অর্থ নেয়ার বদলি চাল, ভেড়া, রংসহ অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে ফড়িয়াদের কাছ থেকে। বছরান্তে এই উপাদানগুলো দিয়েই নতুন বছরের জন্য আবারও কার্পেট বুনতে শুরু করে তারা।
কার্পেটের নকশা নিয়ে সন্তুষ্ট নন আফগান অধিবাসীরা। কারণ তাদের মতে, বর্তমানে বিভিন্ন দেশে যে কার্পেটের নকশা করা হচ্ছে তাতে সত্যিকারের নকশা চাপা পরে যাচ্ছে। কারণ তাদের দৃষ্টিতে, আফগান কার্পেটের নকশা শুধু নকশাই নয়, এই নকশার ভেতরে আছে হাজারো বছরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের পরম্পরা, যা খুব সচেতনভাবে বহন করছে আফগানরা। যন্ত্রচালিত কার্পেট শিল্প শুরু হয়ে যাওয়ার পর আধুনিক পাশ্চাত্য নকশা প্রবেশ করে কার্পেট শিল্পে। এরফলে কার্পেট হয়তো পশ্চিমের দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের গৃহে শোভা পাচ্ছে কিন্তু তাতে ঐতিহ্য হারাচ্ছে প্রাচীন নকশা এবং সংস্কৃতি।
মন্তব্য চালু নেই