জীবনের ঝুঁকিতে শতাধিক রাজনীতিক
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শতাধিক রাজনীতিক জীবনের ঝুঁকির মধ্যে আছেন। সরকারি দলের অনেক নেতাকর্মীও পেয়েছেন হুমকি। গোয়েন্দা তথ্য পেয়ে সতর্ক করা হয়েছে কয়েকজনকে। আশঙ্কায় নিরাপত্তা চেয়েছেন কয়েক নেতা। এদিকে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সম্প্রতি একের পর এক ঘটনায় আতঙ্কের মধ্যেই আছেন রাজনীতিকরা।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার ঘটনাসহ বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচ নেতার বাড়ি-অফিসের সামেনে গুলি বর্ষণ ও বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিরাপত্তার প্রসঙ্গ তুলে থানায় সাধারণ ডায়রি করেছেন চার নেতা।
গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে সন্ত্রাসীদের টার্গেটে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের অনেকের বাসস্থান কেন্দ্রিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবাহান চৌধুরী, যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সাংসদ সদস্য অধ্যাপিকা অপু উকিল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক স ম রেজাউল করিমের বাসায় ২৪ ঘণ্টা পুলিশি নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। সংঘবদ্ধ একটি অপরাধী চক্রের মোবাইল ফোনে রাজধানী কেন্দ্রিক সরকারি দলীয় রাজনীতিকদের হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। এরপর সন্ত্রাসীদের টার্গেটকৃত ওইসব নেতাদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত ১৩ জানুয়ারি ঢাকার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। ওই সভার কাছে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। ৯ জানুয়ারি বোমা হামলা হয়েছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বনানীর বাসার সামনে। রাজনীতিকদের মতো বিচারপতিদের বাসায়ও পড়ছে বোমা। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান যতোদিন ‘পলাতক’ থাকবেন, ততোদিন তার বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞার রায় দেয়া বিচারপতিদ্বয়ের মধ্যে কাজী রেজা-উল হকের ফেনীর বাসায় আগুন দেয় সন্ত্রাসীরা। একই বেঞ্চের অপর বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের ধানমণ্ডির বাসার সামনে বোমা ফাটানো হয়।
এর মধ্যে সরকারি দলের কেউ কেউ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য পুলিশ চেয়ে আবেদন করেছেন। তাছাড়া সরকার দলীয় বেশ কয়েকজন নেতা ও আওয়ামী লীগ সমর্থক কয়েকজন পেশাজীবীর ওপর হামলার ষড়যন্ত্রের আগাম তথ্যও রয়েছে পুলিশের কাছে। এ প্রেক্ষিতে গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ও সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার, সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাবেক সাংসদ সদস্য অপু উকিল ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ স¤ক্সাদক স ম রেজাউল করিমকে পুলিশি নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা এসব রাজনৈতিক ও পেশাজীবী নেতাদের জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। আর বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে গেলে তাদের বলা হয়েছে সতর্কতা অবলম্বন করতে।
জানতে চাইলে অপু উকিল জানান, ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়েছে- সংঘবদ্ধ একটি অপরাধী চক্র তাকেসহ প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ইকবাল সোবাহান চৌধুরী, স ম রেজাউল করিমসহ আরো অনেক আওয়ামীগ নেতাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। এ কারণে গত সপ্তাহ থেকে তারসহ অন্যদের বাসায় পুলিশি নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে।
স ম রেজাউল করিম এ বিষয়ে বলেন, ‘গণমাধ্যমে (টকশো) জামায়াত-বিএনপি বিরোধী কথা বলায় আমাকে ওই গোষ্ঠীর সন্ত্রাসীরাই টার্গেট করতে পারে।’ তবে হত্যার হুমকি পুলিশি নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
গোয়েন্দা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘অতি সম্প্রতি দেশের বাইরের একটি দেশে বিএনপি-জামায়াত ঘরানার এক শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ সংঘবদ্ধ একটি অপরাধী চক্রের বৈঠক হয়। ওই নেতা তাদেরকে বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের নিয়ে হত্যাকাণ্ড চালানোর নির্দেশও দিয়েছেন। সেই সঙ্গে কিছু পুলিশ সদস্যকে অবরোধ-হরতাল অথবা মিছিল-মিটিংয়ে বাধা দেয়ার সময় আক্রমণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এমন তথ্য পাওয়ার পর নড়েচরে বসেছে গোয়েন্দারা। সরকারি দলের অর্ধশতাধিক এমপি, মন্ত্রী ও শীর্ষ পর্যায়ের নেতার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।’
এদিকে গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বলেন, ‘সম্প্রতি বাসাবোর একটি বাসা থেকে সাইফুল্লাহ খান নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ‘বাসাবো মোবাইল সার্ভিসিং ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র অফিস থেকে দুটি রিভলবার, একটি পিস্তল ও এক হাজার রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। এসব অস্ত্র রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতারাই এই চক্রের প্রধান টার্গেট।’
ভয়ে বিএনপি নেতারাও
বিএনপির কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, একের পর এক রহস্যজনক ঘটনায় আতঙ্কের মধ্যে আছেন তারা। গত মঙ্গলবার গুলশানের সুরক্ষিত কূটনৈতিক এলাকায় হামলার শিকার হন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান। ১০ জানুয়ারি তার আরেক উপদেষ্টা সাবিহউদ্দিন আহমেদের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। একইদিনে খালেদা জিয়ার আরেক উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর বাসায় গুলি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
১১ জানুয়ারি রাত ১০টার দিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান ও খন্দকার মোশাররফ হোসেনের গুলশান-২ নম্বরের বাসার সামনে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে দুর্বৃত্তরা। একই দিন বেলা ৩টার দিকে অপর উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেনের রামপুরার মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার চেম্বারের সামনে চারটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। ওই দিন রাত ১১টার দিকে ধানমণ্ডিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকারের বাসার সামনে ফাঁকা গুলি ছোঁড়া হয়।
সাবিহ উদ্দিনের গাড়িতে আগুন এবং মিন্টু, মঈন খান ও মোশাররফ হোসেনের বাসার সামনে গুলি ছোঁড়ার ঘটনায় পুলিশ গুলশান থানায় চারটি জিডিও করেছে। মিন্টুর বাসার একজন নিরাপত্তাকর্মীও থানায় জিডি করেন। মাহবুব হোসেনের চেম্বারের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় রামপুরা থানায় জিডি হয়েছে বলে দাবি করে পুলিশ। তবে জমির উদ্দিন সরকারের বাসার সামনে গুলির ঘটনায় কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
গুলশানের চারটি ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে গুলশান থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি। চারটি ঘটনায় জিডি হয়েছে। রিয়াজ রহমানের ঘটনায়ও ভুক্তভুগীরা মামলা করেনি। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। কারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে, তা এখনো স্পস্ট নয়। তবে আমরা তদন্ত করছি।’
ধানমণ্ডি থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘জমির উদ্দিন সরকারের বাসার সামনে শব্দ হয়েছিল। তবে কিসের শব্দ এবং কে বা কারা তা ঘটিয়েছে, তা জানা যায়নি।’
মন্তব্য চালু নেই