চারুকলায় চলছে জয়নুল উৎসব
মৃদু শৈতপ্রবাহ, শীতে ঝিম ধরা অবস্থা। তার মধ্যেও সাত সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন দৃশ্য। সাধারণ মানুষ, ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নানা বয়সী মানুষের মিলনমেলা বসেছে যেন চারুকলার লিচু তলায়। কিন্তু কেন কি কারণে এ মিলন মেলা? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল, জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবর্ষ উদযাপন ২০১৪ উপলক্ষে একমাস ব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে চারুকলা অনুষদ। সে কারনেই এ মিলন মেলা।
এ উৎসবের মধ্যে রয়েছে বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। জয়নুল গ্যালারিতে দেখা যাবে শুধুমাত্র চারুকলার শিক্ষক ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। চারুকলা প্রাঙ্গনেই চলছে জয়নুল মেলা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকশিল্প সামগ্রীর ১০টি স্টল দেখা যায় এতে। এই স্টলগুলোর দায়িত্বে আছেন ২০ জন শিল্পী। এরমধ্যে রয়েছে কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প, কাঁসাশিল্প, কাঠের তৈরী বিভিন্ন বস্তু, শোলাদ্বারা তৈরি বিভিন্ন রঙের ফুল, সিলেটের, শীতলপাটি শঙ্খ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন বস্তু, নকশি কাঁথা, রিকশা পেইন্টের দোকান। এ মেলা চলবে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী দেখতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহফুজ জানালেন ‘বেশ ভালো লাগছে বিশেষ করে মৃৎশিল্পের তৈরি বিভিন্ন বস্তু, কাসার তৈরি বিভিন্ন বস্তু সোলার তৈরি বিভিন্ন রঙ এর ফুল, নকশী কাঁথা।’
ভিকারুনন্নেসা স্কুলের শিক্ষার্থী লিরা জানালেন ‘এ প্রদর্শনীতে এসে বিভিন্ন শিল্প সামগ্রী দেখতে পাচ্ছি যা আগে কখনো দেখিনি যা আমাকে খুব মুগ্ধ করছে।’ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বকুলতলার মঞ্চে চলছে জয়নুল আবেদিনের স্মৃতিচারণ ও প্রামান্যচিত্র প্রদর্শনী এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
আয়োজকদের কাছ থেকে জানা যায়, জয়নুল উৎসবের আয়োজন শুরু হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। প্রথমদিকে ছাত্ররাই এর আয়োজন করে থাকতেন। ২০০৯ সাল থেকে বড় পরিসরে এ উৎসবটির আযোজন করা হয়। বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর পাশাপশি প্রবর্তন করা হয়েছে জয়নুল সম্মাননা। যারা শিল্পচর্চা ও শিল্প শিক্ষার প্রসারে অবদান রেখেছেন তাদের প্রতিবছর সম্মনিত করা হচ্ছে। এবার সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে ভারতের বারদা এমএস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোলাম মোহাম্মদ শেখ ও শিল্পী সমরজিৎ রায চৌধুরীকে।
এছাড়া এবার ৫ থেকে ৬ ও ১১ থেকে ১২ জানুয়ারি চারটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় জাদুঘর ও ক্রাফট কাউন্সিলের পৃষ্ঠপোষকতায়। এতে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন বাংলদেশের কলাতাত্বিকদের পাশাপাশি ভারতের ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিবাসি শিল্পকলা বিশেষজ্ঞ রাজেশ ভৌমিক ও কলকাতার গুরুসদয় দত্ত সংগ্রহশালার লোকশিল্প বিশেষজ্ঞ বিজন কুমার মন্ডল।
এবছর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন স্বর্ণপদক দেওয়া হয়েছে চন্দ্রনাথ পালকে, নিরীক্ষামূলক শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছেন লিটন পাল, মাধ্যম শ্রেষ্ঠ পুরস্কার সুমন বর্মণ, ভাস্কর নভেরা আহমেদ সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন মহিবুল ইসলাম, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছেন তমা চন্দ্র দাস, শিল্পী আনোয়ার জাহান স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছেন প্রিন্স কুমার শীল। দীর্ঘ একমাসব্যাপী এ অনুষ্ঠান শেষ হবে ১২ জানুয়ারি।
এক স্লিপ জয়নুল আবেদীন
১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার কেন্দুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন জয়নুল আবেদিন। তিনি ‘শিল্পাচার্য’ নামে পরিচিত ছিলেন। তার বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে- দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা, সংগ্রাম, সাঁওতাল রমণী, ঝড় এবং আরো অনেক ছবি। ১৯৭০ সালে গ্রাম বাংলার উত্সব নিয়ে আঁকেন ৬৫ ফুট দীর্ঘ তার বিখ্যাত ছবি নবান্ন। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ। মা জয়নাবুন্নেছা গৃহিনী। নয় ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল আবেদিন ছিলেন সবার বড়। ছেলেবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল। মাত্র ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি বন্ধুদের সাথে কলকাতায় গিয়েছিলেন শুধু মাত্র কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য। তাই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের পড়ালেখার বাদ দিয়ে কলকাতায় চলে যান এবং মায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস-এ ভর্তি হন। ১৯৩৮ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৬ সালের ২৮ মে মৃত্যুবরণ করেন এই মহান শিল্পী।
মন্তব্য চালু নেই