মেয়েরা তো শাড়ি কম পরে, ব্যবসা চলবে কেমনে?
টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী শাড়ির ব্যবসা এখন খারাপ। আর সব ব্যবসায়ীর অনুযোগ—নারীরা এখন শাড়ি কম পরেন। সেখানকার একাধিক ব্যবসায়ী হতাশার সুরে বললেন, ব্যবসা আর কেমনে চলবে? মেয়েরা তো শাড়ি কম পরে। কয়টা মেয়ে এখন শাড়ি পরে? বাসা, অফিস, আদালত—সব জায়গায় তো সালোয়ার-কামিজই পরছেন নারীরা। বয়স্করা আর কয়টা শাড়ি পরবেন? বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক উৎসবেও টাঙ্গাইল শাড়ির চেয়ে ভারত থেকে আসা ঝলমলে শাড়িই জায়গা দখল করে আছে। তবে ঈদ, পয়লা বৈশাখ ও পূজায় অন্যান্য শাড়ির সঙ্গে টাঙ্গাইল শাড়ির বিক্রিও বাড়ে।
গত ২৪ এপ্রিল বিকেলের দিকে কথা হয় টাঙ্গাইলের পাথরাইলের শাড়ি ব্যবসায়ী ও কারিগরদের সঙ্গে। ব্যবসা খারাপের কারণ নিয়ে তাঁদের নানা ব্যাখ্যা আছে। তবে ঘুরেফিরে একবার হলেও সব ব্যবসায়ী বলছেন, নারীরা শাড়ি পরছেন না। এই প্রতিবেদককে উদ্দেশ করে একজন ব্যবসায়ী বললেন, ‘এই যে আপনি আমাদের খবর নিতে আসছেন, আপনিও কিন্তু সালোয়ার-কামিজই পরেছেন, শাড়ি পরেন নাই।’
টাঙ্গাইলে এখন চলে তিন ধরনের তাঁত। এগুলো হলো পিটলুম, সেমি অটো তাঁত (চিত্তরঞ্জন তাঁত) আর বিদ্যুচ্চালিত তাঁত (পাওয়ার লুম)। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য হচ্ছে পিটলুম বা হাতে তৈরি তাঁতের শাড়ি। এর উৎপাদন কমে যাচ্ছে। তবে আগের চেয়ে বেড়েছে চিত্তরঞ্জন তাঁত ও পাওয়ার লুম তাঁতের শাড়ি।
টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের স্বত্বাধিকারী মনিরা এমদাদ বলেন, মেয়েদের শাড়ি পরা কমছে, এটা তো ঠিকই। টাঙ্গাইল শাড়ির বাজারও কমছে। বংশপরম্পরায় এই পেশায় আসার পরিমাণও কমছে। তা ছাড়া মানসম্পন্ন শাড়িও তৈরি কম হচ্ছে। তিনি বলেন, হাতে তৈরি টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যবহার তো অনেক কমেছে। এর কোনো পরিসংখ্যান আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরো চিত্র পাওয়ার মতো কোনো জরিপ নেই। কিন্তু যাঁরা এই ব্যবসার সঙ্গে আছেন, তাঁদের শাড়ির বিক্রি কমেছে। তাঁর নিজের দোকানের বিক্রিও কমেছে।
টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল গ্রামে বেশ কয়েকটি বড় দোতলা দালান। দালানের নিচে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শোরুম। কোনো কোনো শোরুমের পাশেই তাঁতে বসে কারিগরেরা মাকু দিয়ে শাড়ি বুনছেন। এখানে মূলত শাড়ি পাইকারি বিক্রি হয়। পরিচিতজন বা ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষ ফিরতি পথে শাড়ি কেনার জন্য এখানে আসেন।
৩০ বছর বয়সী স্বপন পাল ছোটবেলা থেকে টাঙ্গাইলের শাড়ি বোনেন। শাড়ি বানিয়ে সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকার মতো পান। কোনো কোনো সময় একেকটি শাড়ির পেছনেই চলে যায় ছয় থেকে সাত দিন। মাকু চালাতে চালাতেই তিনি জানালেন, বাজারে অনেক পোশাকের ভিড়ে শাড়ির চাহিদা কমে গেছে। কারিগরেরাও অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। স্বপন পাল যেখানে বসে কাজ করছিলেন, সেখানে সাতটি তাঁতের মধ্যে দুটিই বন্ধ।
সরকারি তথ্য বাতায়নেই আছে, টাঙ্গাইলে হাতে তৈরি শাড়ি তৈরির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ২০ হাজারের কম। সেখানে বলা হয়েছে, তাঁদের একটি বড় অংশই এখন সব সময় শাড়ি তৈরির সঙ্গে যুক্ত থাকেন না।
হরিপদ বসাক অ্যান্ড সন্সের মালিক কালা চাঁদ বসাক ও উত্তম বসাক। তাঁরা দুই ভাই। কালা চাঁদ বসাক বললেন, আজকালকার মেয়েরা শাড়ি পরে না। বিভিন্ন উৎসবে শাড়ি পরলেও তা ভারত থেকে আনা শাড়ি বা অন্য শাড়ি পরে। অবশ্য কালা চাঁদ বসাকের স্ত্রী চায়না রানী বিশ্বাস জানালেন, তিনি সব সময় টাঙ্গাইলের শাড়ি পরেন। পাশেই দাঁড়ানো আরেক গৃহিণী মিনতি বসাক যোগ করলেন, টাঙ্গাইলের শাড়ির মান ভালো। হাতে, বহরে ঠিক হয়। তাই হঠাৎ অন্য শাড়ি পরলে তখন আর ভালো লাগে না।
অবশ্য যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানির তরুণ মালিক খোকন বসাক বললেন, ‘আমার বাড়িরও মেয়েরাও শাড়িবিমুখ। বয়স্ক যাঁরা, তাঁরাই টাঙ্গাইলের শাড়ি পরছেন। কিন্তু তাঁরা আর কয়টা পরবেন? এখন যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে শাড়ির পাশাপাশি তাঁতের বিভিন্ন সালোয়ার-কামিজ তৈরি করছি।’
টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির নেতা রঘুনাথ বসাক বলেন, ২০১৬ সালে ৮ মিলিয়ন ডলারের শাড়ি রপ্তানি হয়েছে। অথচ কয়েক বছর আগেও ১৮ মিলিয়ন ডলারের শাড়ি রপ্তানি হয়েছে। দেশের বাজারেও বিক্রি একইভাবে কমছে। কিন্তু এর হিসাব আলাদাভাবে বের করা হয়নি।
বসাকের ছেলেরাও এ পেশার প্রতি বিমুখ
সরকারের টাঙ্গাইল জেলার ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, টাঙ্গাইলের হিন্দু তাঁতিদের মৌলিক উপাধি বসাক। বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হচ্ছে টাঙ্গাইলের আদি তাঁতি অর্থাৎ আদিকাল থেকেই তাঁরা তন্তুবায়ী গোত্রের লোক। টাঙ্গাইলে বংশানুক্রমে যুগের পর যুগ তাঁরা তাঁত বুনে আসছেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর অনেক বসাক তাঁতি ভারতে চলে যান। যাঁরা টিকে আছেন, ব্যবসা খারাপের জন্য তাঁরা নিজেরাই পিছিয়ে যাচ্ছেন।
যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানির মালিক রঘুনাথ বসাকের পাশাপাশি ব্যবসায় হাল ধরেছেন তাঁর একমাত্র ছেলে খোকন বসাক। তিনি এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। রঘুনাথ বসাকের ভাই রতন বসাকের ছেলে রাজীব বসাক বস্ত্র প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে হাল ধরেছেন নিউ যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানির। তবে রঘুনাথ বসাক বললেন, আস্তে আস্তে বেশির ভাগ বসাক পরিবারের ছেলেরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
কালা চাঁদ বসাকের স্ত্রী চায়না রানী বিশ্বাস জানালেন, তাঁদের তিন ছেলের মধ্যে এক ছেলেও এ পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়নি। গোবিন্দ বসাক অ্যান্ড সন্সের মালিক ধনঞ্জয় বসাকের ছেলের বয়স মাত্র পাঁচ মাস। বললেন, ‘আমি আমার ছেলেকে এ পেশায় আনব না। ব্যবসার অবস্থা ভালো না। লাখ লাখ টাকা বাকিতে দিতে হয়। তা আর তোলা যায় না। সুতার রং, শ্রমিক—সবকিছুর দাম বেশি। পাবনার শাড়িসহ নানান শাড়িও ব্যবসায়ীরা টাঙ্গাইলের শাড়ি বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।’
স্থানীয় বাসিন্দা কবিতা বসাক মেয়েদের জন্য তাঁতের সালোয়ার-কামিজ কিনতে এসেছিলেন একটি শোরুমে। তিনি জানালেন, তাঁদের পাঁচটি তাঁত আছে। একমাত্র ছেলে যদি পড়াশোনায় ভালো না হয়, শুধু তখনই ছেলেকে এ পেশায় আনবেন।
টাঙ্গাইল ব্যবসায়ী সমিতি এবং টাঙ্গাইল বসাক সম্মিলনী লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত রঘুনাথ বসাক বললেন, টাঙ্গাইল শাড়ি বা ব্যবসায়ীদের অবস্থা নিয়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত দেওয়া সম্ভব নয়। বসাকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে জরিপ করা হয়েছিল, সেটাও ২০০১ সালের। বসাকদের পুনর্বাসনে একটি সংস্থা করা হয়েছিল, তা-ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তিনি বললেন, ‘টাঙ্গাইল শাড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারেরও কোনো উদ্যোগ নেই। আমরা এখন পর্যন্ত ধরে রেখেছি বলে চলছে।’ পাথরাইলের নিউ রাধাবল্লভ অ্যান্ড কোং, এম বি অ্যান্ড সন্স, রাধেশ্যাম নীলকমল বসাক, মনমোহন বসাক অ্যান্ড সন্স নামের ঝকঝকে শোরুমগুলো কত দিন টিকে থাকবে, তা কে জানে।-প্রথম আলো
মন্তব্য চালু নেই