‘দেশের তৈরি পোশাক নিয়ে অনৈতিক ব্যবসা করছে বিদেশী ক্রেতারা’
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দাম নিয়ে বিদেশী ক্রেতারা অনৈতিক বাণিজ্য করছে বলে অভিযোগ করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
‘বাংলাদেশের পোষাক শিল্পে কার্যকর সামাজিক সংলাপের প্রভাব’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, রানা প্লাজার মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরও শ্রমিকদের উন্নয়নে বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বায়াররা। এমনকি পোশাকের দামও বাড়ায়নি তারা।
রানা-প্লাজা দুর্ঘটনার চতুর্থ বার্ষিকী উপলক্ষ্যে রোববার রাজধানীর গুলশানের গার্ডেনিয়া গ্রান্ড হলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) যৌথভাবে এই সংলাপের আয়োজন করে। সিপিডির সম্মানীত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় এতে সভাপতিত্ব করেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থার গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তৈরি পোশাক খাতে বর্তমানে একটি অনৈতিক বিজনেস মডেল দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে রেহমান সোবহান বলেন, ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে ৫ মার্কিন ডলারে পণ্য কিনে তা ২৫ ডলারে বিক্রি করে। ওই ৫ ডলার নিয়েই আলোচনা হয়। কিন্তু বাকি ২০ ডলার কোথায় যায়? তা নিয়ে কেউ কথা বলছে না। এখন চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এই ৫ ডলারের উপর অত্যাচার করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আসলে কতদূর এগুতে পারবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ যে বিজনেস মডেল দাঁড়িয়েছে তা নিয়ে কয়েকদিন কথা হবে আবার তা হারিয়ে যাবে। এভাবেই চলতে থাকবে।
দেশের মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সুসম্পর্ক ও সমন্বয় থাকলে সেদিন রানা প্লাজার মতো এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ওই দুর্ঘটনার পর সামাজিক জবাবদিহিতার চরম অভাবের বিষয়টিও ফুটে উঠেছে। জনপ্রতিনিধিরা এ ঘটনার পর্যালোচনা করেননি। সাংসদ বা মন্ত্রী এমনকি সংসদীয় পর্যায়েও এ বিষয়ে ধারাবাহিক কোনো আলোচনা আমরা দেখতে পাইনি।
সিপিডির চেয়ারম্যান বলেন, গত ৪ বছরে এ খাতে সংস্কারে প্রচুর ঘাটতি ছিল। শুধু নীতিকথা বললেই হবে না, সংস্কার করতে হবে। ক্রেতা, উদ্যোক্তা ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের সমতা দরকার। সরকারের সুশাসনেও দুর্বলতা রয়েছে। এগুলো সমন্বয় করা দরকার।
সিপিডির সম্মানীত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রানা প্লাজা ধসের পরে অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। ওই ঘটনার পর ট্রেড ইউনিয়ন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে যে পরিমাণ অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল- তা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার পর দেশে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, কিন্তু সেগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারেনি। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা পর্যাপ্ত সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি, তাদের পুনর্বাসনও হয়নি। এখনও অনেকে বেকারত্ব বরণ করছেন।
সংলাপে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশনের ডেপুটি হেড ইয়োগান হেইম্যান বলেন, আগামী ১৮ মে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এবং এর কর্মপরিবেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আলোচনা হবে। বৈঠকের ফল নেতিবাচক হলে ইউরোপের বাজারে যে অগ্রাধিকার সুবিধা বাংলাদেশ পায়, তাতে সাময়িকভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে।
এ বিষয়ে শ্রম সচিব মিকাইল শিপার বলেন, রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর সরকার যথেষ্ট সচেতন হয়েছে। আশাকরি, উন্নয়ন সহযোগীদের এসব বিষয়ে বোঝাতে সক্ষম হব।
বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ৫ ডলারে পোশাক বিক্রি করতে গেলে ক্রেতাদের বিস্তারিত জানাতে হয়। কিন্তু তারা যখন এসব পোশাক বিদেশে ২৫ ডলারে বিক্রি করেন, তা কত দিয়ে তারা বাংলাদেশ থেকে কিনেছেন তা উল্লেখ করেন না।
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, গার্মেন্টসের মোট শ্রমিক সংখ্যা কত- তা আমরা এখনও জানি না। গত ৮ মাস ধরে বায়োমেট্রিক ডাটাবেজ তৈরির কাজ করছি। এখন পর্যন্ত ১১ লাখ শ্রমিক এর আওতায় এসেছে।
শ্রমিক নেতাদের ট্রেড ইউনিয়নের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, গার্মেন্টস খাতে এখন পর্যন্ত ৫৯১ টি ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। অথচ এসব কারখানার মধ্যে মাত্র ২৬০টি কারখানা চালু রয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হলো আমরা আইন মানছি কি না?
পোশাকের দাম বাড়ানোর বিষয়ে মাহমুদ হাসান বলেন, ক্রেতারা তাদের ব্যবসা নিয়ে চিন্তা করবে। দাম বাড়ানোর চাপ দিলে তারা হয়তো ইথিওপিয়া বা পার্শবর্তী দেশ ভারতে চলে যাবে। কারন পোশাক খাতকে এগিয়ে নিতে ভারত ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতের যেসব রাজ্যে শ্রম স্বস্তা সেসব রাজ্যে তারা কারখানা তৈরি করছে। শ্রমিকদের আর্থিক সুবিধা দিচ্ছে সেদেশের সরকার। এছাড়া উদ্যোক্তাদের সুদবিহীন ঋণ দিচ্ছে। অতএব মাথায় রাখতে হবে যে, তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের নতুন প্রতিযোগী হতে যাচ্ছে ভারত।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিচালক শামসুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। গার্মেন্টস পরিদর্শন বাড়িয়ে দিয়েছি। শ্রমিকদের ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে।
শ্রমিক নেতা কামরুল ইসলাম বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় বিদেশি সংস্থা থেকে ক্ষতিপূরণের একটি প্যাকেজ ও সরকারের কিছু অনদান পেয়েছি। কিন্তু আইনানুগ কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। স্পেকটার্ম গার্মেন্টস দুর্ঘটনার পর নিয়মিত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলেও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গত ৪ বছরে শ্রমিকদের কোনো স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়নি।
সাংসদ বা সরকারের কাছে শ্রমিকদের পক্ষ্যে কোনো আবেদন করছেন কি না রেহমান সোবহানের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আপনারা তো জানেন, সংসদ শ্রমিকদের পক্ষে নেই; কারন অধিকাং সাংসদই কারখানার মালিক। তবে কেউ কেউ তো কিছু করছেই।
মন্তব্য চালু নেই