কেন শিশু-সন্তানদের নিয়ে আত্মঘাতী হচ্ছে জঙ্গিরা?
সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযানে জঙ্গিদের শিশু-সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মৌলভীবাজারের নাসিরপুরে একসঙ্গে চার শিশুকে নিয়ে আত্মঘাতী হয় জঙ্গি সোহেল রানা ওরফে লোকমান। এর আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডেও এক শিশু সন্তানকে নিয়ে আত্মঘাতী হয় জঙ্গি দম্পতি। ডিসেম্বরে রাজধানীর আশকোনার অভিযানেও জঙ্গিদের আত্মঘাতী হওয়ার সময় সঙ্গে ছিল শিশু। তবে সেবারে শিশুটি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। এছাড়াও, নব্য জেএমবির শীর্ষ জঙ্গি নেতা তানভীর কাদেরী তার দুই কিশোর সন্তানকে জঙ্গিবাদের দীক্ষা দেয়। ওই দু’জনের মধ্যে একজন পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও আরেক আত্মসমপর্ণের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে অভিযানে নিহত হয়।
সর্বশেষ মৌলভীবাজারের নাসিরপুরে একসঙ্গে চার শিশু সন্তানকে নিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার পর এ ধরনের ঘটনা নিয়ে চলছে আলোচনা। কেউ কেউ জঙ্গি নির্মূল করতে গিয়ে শিশু হত্যার বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমালোচনা করছেন। কিন্তু নাসিরপুরের অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম শনিবার (১ এপ্রিল) বলেছেন, ‘নাসিরপুরের শিশুরা জঙ্গি নির্মূল অভিযানে নিহত হয়নি।’
ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘শিশুদের মাঝখানে বসিয়ে তিন পাশে তিন জন বসে বিস্ফোরক ভেস্ট বেঁধে আত্মঘাতী হয়েছে। বিস্ফোরণে তিন জনের পেট ও কোমরের অংশ উড়ে গেছে। শরীরে তার জড়িয়ে আছে।’ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এই জঙ্গিরা ইসলামবিরোধী, দেশবিরোধী এবং এতটাই নির্মম যে নিজেদের সন্তানদেরও এরা রেহাই দেয়নি।’
কিন্তু ঠিক কেন শিশু সন্তানদের নিয়ে আত্মঘাতী হচ্ছে জঙ্গিরা-এ প্রসঙ্গে জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনাকারী সিটিটিসি ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব জঙ্গিরা অনেক বেশি মোটিভেটেড তারাই সন্তানদের নিয়ে আত্মঘাতী হচ্ছে। এর নেপথ্যে কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন তারা। শিশুরা জঙ্গিদের কোনও তৎপরতার খবর যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বলে না দিতে পারে। এছাড়া, আত্মঘাতী হয়ে মৃত্যুর পর শিশু সন্তানেরা কার কাছে বড় হবে বা তাদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, সেই দুশ্চিন্তাতেও আক্রান্ত জঙ্গিরা। আবার জঙ্গিদের কথিত ও ভ্রান্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আত্মঘাতী হলে তাদের সঙ্গে শিশুরা ‘জান্নাতবাসী’ হবে। এসব কারণেই শিশুদের সঙ্গে নিয়েই জঙ্গিরা আত্মঘাতী হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন সিটিটিসি কর্মকর্তারা।
ঢাকার সিটিটিসি ইউনিটের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘জঙ্গিরা নানারকম কাজে নারী ও শিশুদের ব্যবহার করছে। বিশেষ করে আস্তানার জন্য বাসা ভাড়া নিতে নারী ও শিশু সঙ্গে থাকলে বিশেষ সুবিধা হয়। এছাড়া, বিস্ফোরক বা আগ্নেয়াস্ত্র বহনে নারী ও শিশুদের ব্যবহার করা সুবিধাজনক। এ কারণেই অনেকে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তেই স্ত্রী ও সন্তানদের নিয় কথিত হিজরত করে থাকে। এক কথায়, সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে স্ত্রী-সন্তানদের বিশেষ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে জঙ্গিরা। স্ত্রী-সন্তানদেরও নিজের মতো জঙ্গিবাদের দীক্ষায় দীক্ষিত করছে, যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রতিবেশী বা স্বজনদের সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকা যায়।’
জঙ্গিবাদ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণার সঙ্গে যুক্ত মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘শিশুরা কিন্তু আত্মঘাতী হচ্ছে না। এদের হত্যা করা হচ্ছে। কারণ অন্তত ৮ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা নেই। ফলে বাবা-মায়ের আত্মঘাতী হওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে তাদেরও প্রাণ দিতে হচ্ছে।’
নূর খান লিটন আরও বলেন, ‘অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকা উচিত যেন কোনও পরিস্থিতিতেই একটি শিশুও মারা না যায়। জঙ্গি আস্তানায় শিশু থাকলে তাদের কিভাবে উদ্ধার করা যায়, সেই বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিত।’
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, আজিমপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা তানভীর কাদেরীর এক ছেলে তাহরীম কাদেরীকে গ্রেফতার করেন তারা। পরে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে রীতিমতো ভড়কে যান। কারণ অল্পবয়সী তাহরীমকে তার বাবা-মা এমনভাবে জঙ্গিবাদে দীক্ষা দিয়েছে যে রিমান্ডেও সে সবাইকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়।
সিটিটিসি কর্মকর্তারা বলছেন, বাবা-মা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়লে শিশু সন্তানদের কিছু করার থাকে না। বাবা-মায়ের অনুগত হয়েই পথ চলতে হয় তাদের। ধীরে ধীরে পূর্ণ মোটিভেটেড হয়ে যায় তারা। শিশুদের জন্য শুধু আলাদাভাবে নয়, জঙ্গিবাদ থেকে সবাইকে দূরে রাখার জন্য কাজ করছেন তারা। কারণ বড়দের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই কেবল শিশুদের জঙ্গিবাদ থেকে দূরে রাখা যাবে।-বাংলাট্রিবিউন
মন্তব্য চালু নেই