রেমিট্যান্স ঘাটতির বড় কারণ অবৈধ মোবাইল ব্যাংকিং
ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের এ সংকটাপন্ন অবস্থার জন্য অবৈধ পথের লেনদেনকেই দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, কাগজে কলমে রেমিট্যান্স কমলেও মোবাইল ব্যাংকিং ও হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধ পথে ঠিকই দেশে আসছে।
তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ২০১৫ সালের চেয়ে ১৭০ কোটি ১৩ লাখ ডলার কম। রেমিট্যান্স প্রবাহের এ নীতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত থাকে ২০১৭ সালেও। তবে সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে রীতিমত ধস নামে রেমিট্যান্স প্রবাহে। এ মাসে বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে একক মাস হিসেবে সবচেয়ে কম পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। মাসজুড়ে মাত্র ৯৩ কোটি ৬২ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠায় প্রবাসীরা। এর আগে ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে সর্বনিম্ন ৯০ কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিল প্রবাসীরা।
রেমিট্যান্স প্রবাহে এ ভয়াবহ ধস নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রবাসীদের উপার্জনের অর্থ ঠিকই দেশে আসছে। তবে বর্তমানে প্রবাসীদের পাঠানো টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে না এসে অন্য অবৈধ চ্যানেলে আসছে।
তিনি বলেন, এতদিন হুন্ডির মাধ্যমে টাকা এলেও এখন নতুন পথ মোবাইল ব্যাংকিংও যুক্ত হয়েছে। কিছুদিন আগেও গণমাধ্যমে এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের রেমিট্যান্স বাজার কীভাবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দখলে চলে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহে ঘাটতির জন্য এটা একটা প্রধান কারণ। এছাড়া মাঝে হুন্ডির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও এখন আবার বেড়েছে। এসব কারণেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমেছে।
সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির সব সূচক এখন স্থিতিশীল। অথচ এই সময়ে রেমিট্যান্সে বড় এই ধাক্কা এসেছে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এভাবে ক্রমাগত কমতির দিকে গেলে শংকার কারণ আছে। কারণ বর্তমানে রেমিট্যান্সই রিজার্ভের সবচেয়ে বড় যোগানদাতা।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে বিদেশিদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ কমার কারণগুলো। এগুলো খুবই শঙ্কাজনক। প্রথম কারণ হলো অবৈধ মোবাইল ব্যাংকিং ও হুন্ডি। দ্বিতীয় কারণ হলো শ্রম বাজার সংখ্যার দিক থেকে ছোট হয়ে আসছে। যে পরিমাণ প্রবাসী দেশে ফেরত আসছে সে হারে বিদেশে মানুষ যেতে পারছে না। তাই এখন আমাদের বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বলেন, রেমিট্যান্স কমার আরো একটি কারণ আছে। তা হলো আমাদের মুদ্রাবাজার দীর্ঘদিন ধরে একই জায়গায় স্থিতিশীল। এ অবস্থায় ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়ায় রেমিট্যান্স কমছে।
তিনি বলেন, রেমিট্যান্সের এ খরা মোকাবেলা করতে হলে সরকারকে স্থানীয় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। যার মাধ্যমে দেশে রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এটা করা গেলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বিকল্প একটা পথ তৈরি হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রেমিট্যান্স কমার প্রবণতা অব্যাহত থাকলেও ফেব্রুয়ারিতে এসে মোটা দাগে কমেছে। এটা অশনি সংকেত। হঠাৎ রেমিট্যান্সে কেন এমন ধস? তাহলে প্রবাসীরা কি দেশে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন? আসলে প্রবাসীরা অবৈধ পথে ঠিকই টাকা পাঠাচ্ছেন। হুন্ডি ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের চতুরতার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক পেরে উঠছে না।
তিনি বলেন, প্রবাসীরা টাকা পাঠাতে ব্যাংকবিমুখ হওয়ার কারণ হলো হয়রানি। ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালে সময়মত পাওয়া যায় না। নানা হয়রানি ও ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
আবু আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত, ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে প্রবাসীরা কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সেগুলো খুঁজে বের করে দ্রুত সমাধান করা। একইসঙ্গে অবৈধ হুন্ডি ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা। তা না হলে দেশের ধীরে ধীরে দেশের রিজার্ভ দুর্বল হয়ে যাবে।’
মন্তব্য চালু নেই