তিস্তায় আরো সময় চায় নয়াদিল্লি
আগামী এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করবেন বলে দুই দেশের নীতিনির্ধারকরা প্রাথমিকভাবে সম্মত হয়েছেন। ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সফরে তিস্তার পানি বণ্টন এবং গঙ্গা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের চুক্তি হচ্ছে না। এই দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঢাকার কাছে আরো সময় চেয়েছে দিল্লি। তবে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য একগুচ্ছ প্রকল্পে অর্থায়ন করতে ভারত চতুর্থ লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণের ঘোষণা দেবে।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঝটিকা সফরে ঢাকা এসেছেন। পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের আমন্ত্রণে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিতে ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর ঢাকায় এলেও তার সফরের মূল বিষয় ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগামী ভারত সফরের সময়সূচি এবং আলোচ্য বিষয় ঠিক করা। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব গতকাল ঢাকায় এসে বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন। আজ সকালে দিল্লির উদ্দেশে তার ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা রয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গতকালের সাক্ষাতে পররাষ্ট্রসচিব ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর দ্বিপক্ষীয় সব বিষয়ে ভারত সরকারের মনোভাব তুলে ধরেন। বিশেষ করে পানি ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীকে দিল্লি সরকারের বার্তা পৌঁছে দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীকে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জানান, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করতে ভারত সরকারের আন্তরিকতার কমতি নেই। এই বিষয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ একাধিক গোষ্ঠীকে ইতিবাচক ভূমিকায় আনতে আরো একটু সময় প্রয়োজন। দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করছে। গঙ্গা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির প্রতিবেদন দাখিলের পর বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত চতুর্থ কিস্তির এলওসি ঋণের ঘোষণা দেবে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীকে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর আমন্ত্রণ পৌঁছে দেন ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর। এতে করে আগামী সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকবেন। যা বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর জন্য ভারতের রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো এমন সম্মান জানানো হচ্ছে। ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্করের সাক্ষাৎ শেষে প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেসসচিব এম নজরুল ইসলাম গতকাল গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যাচ্ছেন।’
পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর সব বিষয়ে আলোচনা করেন। ওই বৈঠকে প্রাথমিকভাবে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ ধরে দুই দেশ প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাব্য সফরের সূচি সাজাতে সম্মত হয়। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক একটি সহযোগিতা চুক্তির জন্য সম্মত হয়েছেন দুই পররাষ্ট্রসচিব। প্রধানমন্ত্রীর সফরে এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিবকে চতুর্থ এলওসির আওতায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। এ জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন, সড়ক ও রেল যোগাযোগ উন্নয়নসহ একাধিক খাতের কমবেশি ২০টি উন্নয়ন প্রকল্পের একটি তালিকা দিয়েছে ঢাকা।
ঢাকা ও নয়াদিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি দায়িত্ব নেয়ার পর অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হয়। নতুন মাত্রায় পৌঁছে ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্ক। কিন্তু এই সম্পর্কের গতিতে রাস টেনে ধরেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বহুকাক্সিক্ষত তিস্তা চুক্তির বিষয়ে একাধিকবার কথা দিলেও তা রাখেননি মমতা। তার আপত্তির কারণেই আটকে আছে তিস্তা চুক্তি। তিস্তার পর সর্বশেষ পদ্মা নদীতে গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপত্তি জানিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার মনে করছে, বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে ব্যারাজ হলে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদে নদীভাঙন তীব্র হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের নয়াদিল্লিকে স্পষ্ট ভাষায় জানান, পশ্চিমবঙ্গকে বন্যা ও ভাঙনের মুখে ঠেলে দিয়ে ঢাকাকে বাঁধ (ব্যারাজ) দিতে দেয়া যাবে না। এমনকি এ নিয়ে দুই দেশের আলোচনার সময়ও পশ্চিমবঙ্গ অংশ নেবে না।
বর্ষীয়ান কূটনীতিক এবং সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বিরাট চ্যালেঞ্জের। এখানে সম্ভাবনার সুযোগের পাশাপাশি পা পিছলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক খুবই স্পর্শকাতর। কেননা বড় একটি রাষ্ট্রের পাশে ছোট একটি রাষ্ট্র মাথা উঁচু করে টিকে থাকা সহজ কথা নয়। দুই দেশের সম্পর্ক অবশ্যই পারস্পরিক লাভজনক হতে হবে। উন্নয়নের জন্য জন-অনুমোদিত পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ নয়াদিল্লিকে বিশেষ সুযোগ দিচ্ছে। বিষয়টি ইতিবাচক এবং আমাদের জন্য লাভজনক। কেননা পূর্বভারতের উন্নতি মানে বাংলাদেশের উন্নতি। পূর্বভারত বাংলাদেশের পাশেই অবস্থিত। ওই অঞ্চলের আর্থিক ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে বাংলাদেশের বাণিজ্য উন্নয়ন ঘটবে। ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন ঘটেছে। সামনে তিস্তাসহ পানি নিয়েও সব সমস্যার সমাধান হবে বলে বিশ্বাস করি।
সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের যোগাযোগ খাতে অনেক উন্নতি ঘটেছে। এটাও ইতিবাচক। কেননা মানুষের আনাগোনার মধ্যেই রচিত হয় সুসম্পর্ক। মানুষে-মানুষেই দুই দেশের সংযোগ ঘটায়, হৃদ্যতা বাড়ায়, সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে।
মন্তব্য চালু নেই