চার বছরে কোথায় পৌঁছল গণজাগরণ মঞ্চ?

বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে ঢাকার শাহবাগে গড়া ওঠা দীর্ঘস্থায়ী একটি স্বত:স্ফূর্ত আন্দোলনের চার বছর পূর্তি হল গতকাল রবিবার।
দিনের পর দিন ধরে চলা শাহবাগ আন্দোলনের সেই সময়ের সামনের সারির অনেককেই আজও দেখা যায় বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে শাহবাগে একজোট হতে। যদি ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সাথে তুলনা করলে এদের সংখ্যা নিতান্তই ক্ষীণ।
দেখা যাচ্ছে শাহবাগের এই আন্দোলনকারীদের মূল যেসব দাবিদাওয়া ছিল তার প্রায় সবটাই পূরণ হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য করা একটি আইনে পরিবর্তন আনা থেকে শুরু করে বেশির ভাগ শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীরই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে গেছে এরই মধ্যে।
কিন্তু এখনও কি এই শাহবাগ আন্দোলনের আর প্রাসঙ্গিতকতা আছে?
২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি বিকেল। একদল তরুন তরুনী প্ল্যাকার্ড হাঁতে দাঁড়িয়ে গেল শাহবাগে জাতীয় যাদুঘরের সামনে।
এরা মূলত ব্লগার এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট। এরা বিক্ক্ষুব্ধ, রাগান্বিত। সকালবেলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাত্তর সালের একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
কিন্তু এই বিক্ষোভকারীরা তার ফাঁসি চান। অথচ আইনটিই এমন, তাকে ফাঁসি দেবার দাবি নিয়ে উচ্চতর আদালতে যাবার সুযোগ আর নেই।
সন্ধ্যে নাগাদ বিক্ষোভকারীরা এসে শাহবাগ চত্বর দখল করে, বন্ধ হয়ে যায় যানবাহন চলাচল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে একের পর এক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন এসে যোগ দিতে থাকে, আস্তে আস্তে শাহবাগ হয়ে ওঠে লাখো মানুষের গণ্তব্য, যা অব্যহত থাকে পরের দিন, তার পরের দিন, এবং বহু দিন পর্যন্ত।
ওই আন্দোলনের সূত্র ধরেই পরবর্তীতে আইন পরিবর্তন করা হয় এবং পরিবর্তিত আইনে উচ্চতর আদালত কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, এবং আরো বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীকেই ফাঁসি দেয়া হয়।
গণজাগরণ মঞ্চে শুরু থেকেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক সংগঠন শ্লোগান একাত্তরের নেতা দেলোয়ার হোসেন রনি। তিনি সেসময় ছাত্র ছিলেন, এখন তিনি পেশাজীবনে প্রবেশ করেছেন।
তিনি বলছেন, “আমাদের মঞ্চটা ছিল যুদ্ধাপরাধ-বিরোধী একটা মঞ্চ। ফলে যতদিন না দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপর্ব শেষ হবে ততদিন আমার মনে হয় এই মঞ্চর কাজ চালিয়ে যাওয়াই উচিত হবে। ”
অবশ্য শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র, যিনি এই মঞ্চটির প্রধান নেতা বলেই পরিচিত, সেই ইমরান এইচ সরকার বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির পাশাপাশি তাদের আরেকটি মূল দাবি ছিল সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
কিন্তু মি. সরকারের ভাষায় সেই দাবি এখনও অর্জিত হয়নি, ফলে গণজাগরণ মঞ্চের প্রাসঙ্গিতকতা এখনো রয়ে গেছে, এবং এই মঞ্চ ‘মৃত্যু বরণও করেনি’।
তিনি বলছিলেন, “গণজাগরণ মঞ্চের শুরুতে যেমন লাখো জনতার জমায়েত হয়েছিল, পরে যখন সংখ্যালঘু নির্যাতন বা তনু-হত্যার মতো অন্যান্য ইস্যুতে আমরা আন্দোলন করেছি তখন হয়তো সব সময় অত লোকসমাগম হয়নি। কিন্তু মানুষের সাড়া যে আমরা পরেও পেয়েছি তাতে কোনও ভুল নেই। ”
তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া ব্যতিরেকে অন্য কোন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনে গণজাগরণ মঞ্চের বিশেষ সাফল্য দেখেন না সাংবাদিক ও গবেষক আফসান চৌধুরী। অথচ মি. চৌধুরীর মতে এই মঞ্চটির একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবার সুযোগ ছিল।
তার কথায়, “গণজাগরণ মঞ্চের যে আদর্শ-বিশ্বাসগুলো ছিল তা একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত করা গেলে খুব ভাল হত। কারণ আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে তো কোনও রাজনীতি হচ্ছে না। হয় আওয়ামী লীগ হতে হবে কিংবা বিএনপি – এটা তো কোনও ভাল কথা নয়। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চ সেই বিকল্প রাজনীতির মঞ্চ হয়ে উঠতে পারল না।”
আফসান চৌধুরী আরো বলছেন, এই মঞ্চটি একসময় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিল বটে, কিন্তু শেষমেষ তাতে তারা সফল হয়নি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। আর ইমরান এইচ সরকারের ভাষায়, তারা রাজনৈতিক দল নাহলে, রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের মঞ্চ বটে, এবং জনগণ চাইলে ভবিষ্যতে এই মঞ্চকে রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেন না তিনি।সূত্র : বিবিসি বাংলা
মন্তব্য চালু নেই