যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইতিহাস পাঠ্যসূচিতে সংযোজনের দাবি
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের দণ্ড কার্যকর হচ্ছে একের পর এক। এখন এই বিচারের ইতিহাস পাঠ্যসূচিতে সংযোজনের দাবি উঠেছে। বিচার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের দাবি- বারবার ইতিহাস বদলে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছে। তাই এখনই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নথি বোধগম্যভাবে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। তারা বলছেন, এই বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস যদি পাঠ্যসূচিতে ঢোকানো না যায় তাহলে ইতিহাস হারিয়ে যাবে।খবর বাংলা ট্রিবিউনের।
২০০৭ সালের ৩ মে হাইকোর্টের এক রায়ে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি বা সমপর্যায়ভুক্ত সব শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে বলা হয়। ওই রায়ের আলোকে মাধ্যমিক পর্যন্ত কিছু ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তা খুবই সীমিত। এ প্রেক্ষাপটে আইন কমিশন থেকে ২০১৪ সালে সর্বস্তরে বাধ্যতামূলকভাবে মুক্তিযুদ্ধের তথা ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষার সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে চিঠি দেওয়া হয়। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে পাঠ্যসূচিতে নেওয়ার দাবি এবারই প্রথম জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাদের বিচার হয়েছে তাদের বিচারপ্রক্রিয়া ও অপরাধগুলো সবার সামনে তুলে ধরার কাজটি করার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। তিনি বলেন, ‘একটা পর্যায় শেষ হয়েছে, কিন্তু সেটিকে ডকুমেন্টেড করার কাজটি মোটেও ছোট কাজ না। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থীরা যেভাবে বিষয়টি ধরতে পারবে সেভাবেই তা উপস্থাপনের কাজ শুরু হওয়া দরকার।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ মনে করেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের বরাবর অপরাধ অস্বীকারের যে প্রপাগান্ডা সেখান থেকে পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করতে পাঠ্যসূচিতে বিচারের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার চেয়ে ভালো আর কোনও উপায় নেই। তিনি বলেন, ‘এই বিচারের ইতিহাস যদি গণমানুষ জানতে না পারে, তাহলে সেটা একটা জায়গায় আটকে থাকবে এবং সেটা যেকোনও সময় আবারও বিকৃত করার চেষ্টা হতে পারে।’
তুরিন আরও বলেন, ‘তৃণমূলে যেভাবে জামায়াত তার নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে সেটাকে ভেঙে ফেলার জন্যও এটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।’ জামায়াতের তৃণমূলের শক্তি বিষয়ে জানাতে গিয়ে তুরিন বলেন, ‘পাকিস্তানের চেয়েও বাংলাদেশে কেন জামায়াত ভালো অবস্থানে আছে এ বিষয়ে পাকিস্তানের হাম কাদম পত্রিকায় দণ্ড কার্যকর হওয়া শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী বলছিলেন, উনি মন্ত্রী থাকাকালীন কৃষক বোর্ড তৈরি করেছিলেন। ঋণ দেওয়া হয়েছিল এই শর্তে যে জামায়াতে যোগ দিতে হবে।’
যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ অস্বীকারের চেষ্টা অন্যান্য দেশেও হয়েছে। ১৯৪৫-এর ২৬ জুলাই ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে সমাপনীতে জাস্টিস জ্যাকসন শেক্সপিয়ারের ‘রিচার্ড দি থার্ড’ নাটকের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘অভিযুক্তরা বলছেন তারা হত্যা, হত্যার পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের এই দীর্ঘ তালিকায় বর্ণিত অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তারা এই বিচারের সামনে এমনভাবে নিজেদের দাঁড় করিয়েছেন যেভাবে রক্তরঞ্জিত গ্লচেস্টার দাঁড়িয়েছিলেন তার নিহত রাজার লাশের সামনে। এদের মতো গ্লচেস্টারও বিধবা রানীকে বলেছিলেন, আমি হত্যা করিনি। রানী জবাবে বলেছিলেন, ‘তাহলে বলো তারা নিহত হয়নি, কিন্তু তারা মৃত।’ যদি অভিযুক্তদের সম্পর্কে বলা হয় এরা নিরাপরাধ, তাহলে তা এমনই সত্য হবে যুদ্ধ বলে কিছু হয়নি, কেউ নিহত হয়নি, কোন অপরাধের ঘটনাও ঘটেনি।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত যতগুলো রায় হয়েছে সব বিচারের সময়েই আসামিপক্ষ স্বীকার করেছে একাত্তরে হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত হয়েছে। তবে কোনোভাবেই তাতে আসামিরা জড়িত ছিলেন না। একারণেই রায়ে দেওয়া বিচারকদের পর্যবেক্ষণগুলো অনুবাদ করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে দেওয়া দরকার বলে মনে করেন প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘এ কাদের মোল্লা সেই কাদের মোল্লা না। অপরাধ সংঘটনের সময় মীর কাসেম চট্টগ্রাম ছিলেন না। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দেশেই ছিলেন না-এরকম দাবি করা হয়েছে। অভিযুক্তরা শুরু করে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ফলে রায় ও বিচারপ্রক্রিয়াটি সবার জানা দরকার। অতীতে নানাভাবে ইতিহাস বিকৃত করার হয়েছে। হাতে ধরে সে সুযোগ আবারও কাউকে দেওয়া ঠিক হবে না।’
রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ এর আহ্বায়ক সুলতানা কামাল বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, এর প্রকৃত চেতনা ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে বারবার। সেটা যেন আবার না ঘটে সেই প্রচেষ্টায় আমাদেরই সক্রিয় থাকতে হবে। পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মকে বিষয়গুলো জানাতে হবে।’
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবীর মনে করেন যারা এই বিচার বিলম্বিত, প্রশ্নবিদ্ধ করতে ষড়যন্ত্র ও সহিংসতা করেছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, ‘এসব ষড়যন্ত্র ও অন্তর্ঘাত দেশের ভেতর মোকাবিলা করতে হবে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আইনগতভাবে। আর পাঠ্যপুস্তকে বিচারের বিষয়টি নিয়ে সঠিকভাবে জানাতে হবে এবং সেটার দায়িত্ব বিচার সংশ্লিষ্টদেরই দিতে হবে। বাইরে থেকে কেউ হুট করে কাজটি সঠিকভাবে নাও করতে পারে।’
মন্তব্য চালু নেই