ধূমকেতুর আবর্তন ও সৃষ্টিকাহিনি

গ্রহ উপগ্রহ ও গ্রহাণুপুঞ্জ ছাড়াও সৌরজগতে রয়েছে ধূমকেতু ও উল্কা। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ আকাশে ধূমকেতু দেখে আসছে। তখন আকাশে ধূমকেতু দেখাকে অশুভ সংকেত মনে করা হতো। তখন মনে করা হতো সামনে বড় রকমের যুদ্ধ কিংবা মড়ক অপেক্ষা করছে।

কিন্তু যুগে যুগে ধূমকেতু নিয়ে মানুষের একাধিক রকমের জল্পনা কল্পনা ও কুসংস্কার পাল্টেছে। মানুষ এখন ধূমকেতুর আসল রহস্য উদ্ঘাটন করতে পেরেছে। সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্কার করতে পেরেছে ধূমকেতুর সৃষ্টিকাহিনি।

ধূমকেতু হল ধুলো, বরফ ও গ্যাসের তৈরি এক ধরনের মহাজাগতিক বস্তু। এটি শুধুমাত্র সৌরজগতে দেখতে পাওয়া যায়। এটি একটি ক্ষুদ্র বরফাবৃত সৌরজাগতিক বস্তু যা সূর্যের খুব নিকট দিয়ে পরিভ্রমণ করার সময় কখনো কখনো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং তখন আমরা তাকে দেখতে পাই। ধূমকেতুর ওপর সূর্যের বিকিরণ ও সৌরবায়ুর প্রভাবের কারণে এমনটি ঘটে।

ধূমকেতু মূলত বরফ, ধূলা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথুরে কণিকার একটি দুর্বল মিলনে তৈরি হয়ে থাকে। দেখতেও কিছুটা অদ্ভুত রকমের। এর সামনে রয়েছে গোলাকার মাথা আর পেছনে উজ্জ্বল লেজ। অতি দীর্ঘ একটি ডিম্বাকার পথে এটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।

ধূমকেতুর আকার বেশ মজার। একটি ধূমকেতু প্রস্থে মাত্র কয়েকশ মিটার থেকে দশ কিলোমিটার এবং দৈর্ঘ্যে কয়েকশ কোটি কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

কিছু কিছু ধূমকেতু সূর্যের খুব নিকট দিয়ে বারবার পরিভ্রমণ করার কারণে উদ্বায়ী বরফ ও ধুলা হারিয়ে ছোট গ্রহাণুর মতো বস্তুতে পরিণত হয়। এবং সেখান থেকে কখনো কখনো নীহারিকার সৃষ্টি হয়- যা থেকে আবার কখনো নক্ষত্রের সৃষ্টিও হতে পারে।

ধূমকেতুর আবর্তনের বেশ কিছু ধরন মানুষ ইতোমধ্যেই আবিষ্কার করতে পেরেছে। বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন যে অধিকাংশ ধূমকেতুই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে গ্রহের মতো বৃত্তাকার পথে নয় বরং উপবৃত্তাকার বা ডিম্বাকার পথে। আর এতে করে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে ধূমকেতুর অনেক সময় লেগে যায়। এ সময় একশো বছর থেকে কয়েক লাখ বছর পর্যন্ত হতে পারে। যে কারণে মানুষ সম্প্রদায়ের স্বল্পায়ু থাকায় নিয়মমাফিকভাবে এইসব ধূমকেতুর আবর্তন মানুষের হিসাবের মধ্যেই রাখা কষ্টকর হয়ে যায়।

কারণ মাত্র এক হাজার বছরের মধ্যে মানুষের একটি সভ্যতার সমাপ্তি ঘটে যেতে পারে। যে কারণে ধূমকেতু আবর্তনের এই হিসাব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহন করে নিয়ে যাওয়াটাও অনেক চ্যালেঞ্জের এবং এখনো পর্যন্ত একমাত্র হ্যালির ধূমকেতু ছাড়া সেটা বিশদভাবে সম্ভব হয়নি। কারণ হ্যালির ধূমকেতুটি অপেক্ষাকৃত অনেক কম সময়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় ৭৬ বছর।

মাত্র ৭৬ বছর পর পর এটি নিয়মিতভাবে পৃথিবীর আকাশে দেখা যায়। ১৬৮২ সালে বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালি একটি উজ্জ্বল ধূমকেতু দেখতে পান। তারপর তিনি সেটাকে পর্যবেক্ষণ করে বলেন ধূমকেতুটি প্রতি ৭৬ বছর পর পর পৃথিবীর আকাশে দেখা যায়। তার এই ভবিষ্যতবাণীর পর নথিপত্র এবং পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতার বিভিন্ন শ্রুতিগল্প এবং শিলালিপি সহ বিভিন্ন কিছুর ওপর বিষদ গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন মানুষ হ্যালির ধূমকেতু দেখে প্রথমবারের মতো সেই তথ্য সংরক্ষণ করে রেখেছিল ২৪০ খ্রিস্টপূর্বে।

এরপর ব্যাবিলনে এই একই রকম দেখতে ধূমকেতুটি দেখা গিয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৬৩ সালে। তারপর খ্রিস্টপূর্ব ৮৭ সালে পুনরায় ধূমকেতুটি দেখে ব্যাবিলন এবং চীনারা। গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেন যে ধূমকেতুর নাম হ্যালির ধূমকেতু রাখা হয়েছে সেটিই নিয়মিত ভাবে প্রতি ৭৫-৭৬ বছর পর পর পৃথিবীর আকাশে দেখা যায় এভাবে দেখা যায়। পৃথিবীতে আবির্ভাবের অনেক পরে মানুষ হিসাব করতে শিখেছে বলে এই ধূমকেতুর হিসাব মানুষ অনেক পরে থেকে রেখেছে। ১৬৮২ সালে ধূমকেতুটি দেখার পর হ্যালি বলেন আগামী ৭৬ বছর পর ধূমকেতুটি আবার পৃথিবীর আকাশে ফিরে আসবে। এরপর যখন ১৭৮২ সালে ধূমকেতুটি আবার যথাসময়ে দেখা যায় তখন সাড়া পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। ৭৬ বছর পর পর ১৮৩৫ ও ১৯১০ সালে ধূমকেতুটি দেখা যায়। এরপর সর্বশেষ ধূমকেতুটি দেখা যায় ১৯৮৬ সালে, বাংলাদেশ থেকেও কয়েক ঘণ্টার জন্য দেখা গিয়েছিল ধূমকেতুটি। সেবারের হ্যালির ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ করেছিল পাঁচটি অনুসন্ধানী মহাকাশযান। এগুলোর মধ্যে ছিল দুটি জাপানী, দুটি রুশ এবং একটি ইউরোপীয়।

রুশ মহাশূন্যযান ভেগা-১ ধূমকেতুটির সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছেছিল ৬ মার্চ ১৯৮৬ সালে। এরপর ভেগা-২ এর সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছায় ৯ মার্চ। ইউরোপীয় মহাশূন্যযান গিমটো ধূমকেতুটির মাথা থেকে প্রায় ৬০৫ কিলোমিটার দূরে পৌঁছেছিল ১৩-১৪ মার্চ তারিখে। মানুষের হিসাবে এ পর্যন্ত ২৯ বার নিয়মিতভাবে পর্যায়ক্রমে দেখা গিয়েছে এই ধূমকেতুটি। সে অনুসারে আগামী ২০৬১ সালে আবারো দেখা যাবে হালির ধূমকেতুটি। যারা সে পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন তাদের কতই না সৌভাগ্য!

যা হোক, ১৯৮৫ সালে মহাকাশযানের মাধ্যমে হ্যালির ধূমকেতুর সবকিছু বিশ্লেষণের পর পাওয়া যায় ধূমকেতুর আসলে নিজস্ব কোনো আলো নেই। এর ভেতর আছে জমাটবাঁধা বরফ, গ্যাস, ধূলিকণা, উল্কাপিণ্ড। ধূমকেতুর এই সমস্ত পদার্থ সূর্যের আলোয় প্রতিফলিত হয় বলেই ধূমকেতুর গ্যাসপুঞ্জ ও ধূলিকণাকে উজ্জ্বল দেখায়। এজন্য সূর্যের আলো এর ওপর সরাসরি না পড়া পর্যন্ত এটা দেখা যায়না।

হ্যালির ধূমকেতুর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার। উপবৃত্তাকার পথের ধূমকেতু নিয়মিত হয়ে থাকে। তবে উপবৃত্তাকার ছাড়াও অধিবৃত্তাকার পথের ধূমকেতু আকাশে দেখা গিয়েছে। এগুলো অনিয়মিত হয়ে থাকে।

শৌখিন জাপানী জ্যোতির্বিদ ইউজি ইয়াকুতাকা ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে একুইলা ও সিগনাসের মধ্যবর্তী অঞ্চলে একটি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন। এটির নাম দেওয়া হয় সি/১৯৯৫ ওয়াই-১। ১৯৯৬ সালের ৩০ জানুয়ারি পৃথিবী থেকে মাত্র ২৮ কোটি কিলোমিটার দূরে আরো একটি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন তিনি। মাত্র ৬ সপ্তাহ এটি খালি চোখে দেখা যায়। ইয়াকুতাকার নামানুসারে ধূমকেতুটির নাম রাখা হয় ধূমকেতু হায়াকুতাকা।

এই শতকের শেষ উজ্জ্বল ধূমকেতু র নাম হেল-বপ। ১৯৯৫ সালের ২৩ জুলাই আমেরিকার নিউ ম্যাক্সিকো শহরের এলেন হেল এবং অ্যারিজোনার স্টানফিল্ড-এর টমাস বপ এটি আবিষ্কার করেন। দুজনের নামকরণে এটির নামকরণ করা হয় হেল-বপ।

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- ধূমকেতু নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এতো কৌতূহল এবং বিশ্লেষণ কেন। এতে কি লাভ। আসলে বিজ্ঞানীরা প্রথম থেকেই মনে করতেন ধূমকেতুতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে। এবং অন্যসব গ্রহ উপগ্রহ থেকে একেবারে স্বতন্ত্র রকমের কক্ষপথ থাকায় ধূমকেতু নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতূহল ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

প্রাচীনকালে অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী ধারণা করতেন এমন ভিন্ন ধরনের কক্ষপথে আবর্তিত হওয়ার কারণে পৃথিবীর সঙ্গে যদি কোনো বড় ধূমকেতুর সংঘর্ষ হয় তাহলে আমাদের কি হবে! এদিকে গ্রহের সঙ্গে ধূমকেতু সংঘর্ষের ঘটনা ইতোমধ্যেই ঘটে যাওয়ার কারণে ধূমকেতু আরো বেশি পর্যবেক্ষণের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংঘর্ষের এই ঘটনাটা ঘটেছিল বৃহস্পতি গ্রহের সঙ্গে।

১৯৯৩ সালে ২৩ মার্চ ইউজিন শুমেকার, তার স্ত্রী ক্যারোলিন শুমেকার এবং ডেভিড লেভি নামক এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী পালামোর মানমন্দিরে বসে আবিষ্কার করেন একটি নতুন ধূমকেতু। এটার নাম দেওয়া হয় ‘শুমেকার-লেভি-৯’। এটি ছিল সূর্যের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুতি ঘটা একটি ধূমকেতু। বৃহস্পতির কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় বৃহস্পতির আকর্ষণে সে কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। এপ্রিল মাসে পর্যবেক্ষণ থেকে জানা গেল এটি বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। শুরু হল অবিরাম নিবির পর্যবেক্ষণ। এই কাজটি চলছিল মার্সডন প্রপালশন ল্যাবরোটরি থেকে। অনেক গাণিতিক হিসাবের পর মার্সডন থেকে ঘোষণা করা হয় ‘শুমেকার লেভি-৯’ ধূমকেতুটি ২১ খণ্ড হয়ে আছড়ে পড়বে বৃহস্পতির ওপর।

অবশেষে ১৯৯৪ সালের ১৬ জুলাই ঘটলো সেই ঘটনা। সত্যিই ২১ খণ্ডে বিভক্ত হয়ে ধূমকেতুটি আছড়ে পড়লো বৃহস্পতির বুকে। এবং এই পতিত হওয়ার বেগ ছিল ৬০ কিলোমিটার/সেকেন্ড। শেষ খণ্ডটির পতনদৃশ্য ধারণ করে গ্যালিলিয় নভোযান।

ভবিষ্যতে পৃথিবীর ওপর যদি এমন কোনো অমানিশা নেমে আসে তাহলে আমরা কি পারবো সেটা থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে? প্রশ্ন রয়েই যায়- আর ক্রমেই বেড়ে চলে বিজ্ঞানীদের আকাশ ভাবনা…।

তথ্যসূত্র:
* হ্যালি কমেট অন ব্যাবিলন ট্যাবলেট : ইয়াও এইচ হাংগার
* লস্ট প্রিয়ডিক কমেট : এম ম্যায়ার
* মহাবিশ্বের উৎস সন্ধানে : শঙ্কর মুখোপাধ্যায়
* সৌরজগৎ : সুব্রত বড়ুয়া
* তারার দেশের হাতছানি : আবদুল্লাহ আল-মুতী
* সূর্যের বন্দী : ড. শঙ্কর সেনগুপ্ত



মন্তব্য চালু নেই