এদেশে কারাগারে পাঠালেও তো প্রাণে বাঁচবো

বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্তের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন চলছে। সেদেশের সেনাবাহিনীর গুলিতে এবং তাদের পাশাপাশি রাখাইন যুবকদের ধারালো অস্ত্রে নির্বিচারে খুন হচ্ছেন মুসলিম তরুণ-যুবক-বয়োবৃদ্ধ পুরুষ।

যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তরুণী ও মাঝ বয়সী নারীও। নৃশংসতার হাত থেকে বাদ যাচ্ছে না শিশুও। জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঘরবাড়ি। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মিয়ানমারে উদ্ভূত সহিংস পরিস্থিতি নিয়ে দেয়া বিবৃতিতে এসব তথ্য প্রচার পাচ্ছে।

এদিকে, জাতিগত নিপীড়নের শিকার অসংখ্য আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের সীমান্ত পার হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে। দিনে-রাতে সমানভাবে অনুপ্রবেশের চেষ্টায় মত্ত রয়েছে আতঙ্কিত মুসলিম রোহিঙ্গারা।

এ কারণে স্থল ও জল সীমান্তে নিয়মিত টহলের পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড এবং পুলিশ অতিরিক্ত টহল জোরদার করেছে। এর পরও দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। গত কয়েক দিনে নিপীড়িত কয়েক হাজার রোহিঙ্গা টেকনাফের লেদা ও উখিয়ার কুতুপালংয়ের অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও আশ্রয় নিয়েছে।

মঙ্গলবার বিকেলে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি ঘুরে দেখা যায়, আগে থেকে এখানে অবস্থান করা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু বস্তিসংলগ্ন পাহাড়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে সীমান্ত পেরিয়ে আসা স্বজন কিংবা পাড়ালিয়াদের একটু ঘরে নিতে। এ সময় বিজিবি সদস্যরা ওই রোহিঙ্গাদের সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে বস্তির পাহাড়ে অবস্থান নেয়।

রোহিঙ্গা বস্তির বাসিন্দা আবু তৈয়ব জানান, আমরাও নিপীড়িত হয়ে দেশ ছেড়েছি। তাই বিপদাপন্ন হওয়ার যন্ত্রণা বুঝি। রোববার ভোররাত থেকে বেশ কিছু রোহিঙ্গা প্রাণ নিয়ে সপরিবারে পালিয়ে এসেছেন। অন্য দেশে অবৈধ আশ্রিত হলেও তাদের আমাদের সঙ্গেই থাকার ব্যবস্থা করেছি।

আবু তৈয়বের সহযোগিতায় অনুপ্রবেশকারী ১১ সদস্যের একটি রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়।

পরিবারপ্রধান মোহাম্মদ হাসেম (৩০) জানান, তারা মংডু কেয়ারীপাড়ার বাসিন্দা। মিয়ানমার সেনা সদস্যরা তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ায় প্রায় ২০ দিন ধরে বন-জঙ্গলে লতাপাতা খেয়ে অবস্থান করেন। প্রায় ছয় মাইল পাহাড়ি পথ হেঁটে নাফনদী পর্যন্ত এসে নৌকায় উনচিপ্রাং সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে কুতুপালং বস্তিতে এসেছেন।

স্ত্রী আরেফা বেগম (২৫), মেয়ে নুর কেয়াস (১০), ফায়সাল (৮), নইমা (৭), কবুরা (৫), কাবিনা আকতার (২), মা সবে মেরাজ (৫৫), ভাই জহিরুল ইসলাম (২৫), মোহাম্মদ রফিক (১৮) ও বোন সমুদা খাতুনকে (১৯) নিয়ে প্রাণে বেঁচে আসতে পারায় সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করে হাসেম বলেন, আমরা এখানকার (বাংলাদেশে) জন্য বোঝাস্বরূপ।

কতটুকু অসহায় হলে মানুষ নিজ জন্মভিটা ছাড়ে, তা আমাদের অবস্থানে না পড়লে কেউ বুঝবেন না। এখানকার সরকার কারাগারে দিলেও তো প্রাণে বাঁচব। ওখানে (আরাকানে) পাখির মতো গুলি ও পশুর মতো জবাই করে হত্যা করা হচ্ছে।

মঙ্গলবার সকালে ক্যাম্পে আসা কামাল আহমদ (৪৫) জানান, কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে মংডুর খিয়ারিপাড়ার ইসলাম (৭২), সিরাজুল ইসলাম (৭০), নুরুল কবির (৩৫), ফজল করিম (৩২), কবির (২৫), ইউনুছ (৪০), লুৎফুর নেছা (২৫), নুরুল আলম (৩০), খাইরুল আমিন (১৮), শামসুল আলম (৪০), আনিছুল­াহ (৩০) ও আবদুল আমিনসহ (১২) একসঙ্গে ৩৫ পরিবারের দেড় শতাধিক লোক একই সীমান্ত দিয়ে এপারে এসেছেন।

তাদের মতে, প্রথমে তল­্লাশি করে বাড়ির ব্যবহারের দা ও ধারালো অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশ। এরপর তাদের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। পথে যাকে পাচ্ছে গুলি করছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে রাখাইন যুবকেরা। তারা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করেছে অনেক যুবক, তরুণী ও শিশুকে।

অপরদিকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় রোববার রাতে নাফ নদীতে রোহিঙ্গাবোঝাই একটি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে নারী-শিশুসহ ১০ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে। খবর পেয়ে টেকনাফের জাদিমুড়া এলাকার একটি ট্রলার নদীতে ভাসমান অবস্থায় ২০ জনের মতো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে উদ্ধার করে।

তবে নৌকায় থাকা শিশুসহ ১০ জন নিখোঁজের হদিস মঙ্গলবার পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। নৌকাডুবির এ ঘটনায় রোকেয়া বেগম ও হুমায়ুন কবির দম্পতি বেঁচে গেলেও তারা আনোয়ার ইব্রাহিম (৮), আফসান বিবি (৫) ও ইমরান (৩) নামে তিন সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায়।

তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি ম্যানেজম্যান্ট কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক বলেন, গত এক সপ্তাহে শতাধিক পরিবারের প্রায় হাজারের অধিক রোহিঙ্গা নতুন করে কুতুপালং বস্তিতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মাঝে নারী ও শিশুর আধিক্য বেশি। পুরুষের সংখ্যা কম। যারা এসেছে তাদের অনেকের পরিবার কর্তা নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছেন।

আবু ছিদ্দিক আরো জানান, আরো কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মঙ্গলবার ভোরে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাদের উনছিপ্রাং সীমান্তে, হোয়াইক্যং ও বালুখালী চেকপোস্ট এলাকায় আটকে রেখেছে বিজিবি সদস্যরা। তিনি এখানে আনুমানিক ৫ রোহিঙ্গা থাকার খবর পেয়েছেন বলে উল্লে­খ করেন।

রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত উখিয়া সদর রাজাপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর কুতুপালং ওয়ার্ড সদস্য বখতিয়ার আহমদ বলেন, গত কয়েক দিনে কয়েক শতাধিক রোহিঙ্গা কুতুপালং বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানতে পেরেছি। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকেও অবহিত করেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

উখিয়া থানা পুলিশেল ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল খায়ের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ খবর পেয়েছেন স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হয়েছে। এখনো কোনো দিকনির্দেশনা আসেনি।

কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্প ইনচার্জ আরমান শাকিল বলেন, তার ক্যাম্পে যেন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা প্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

তবে, টেকনাফের উনছিপ্রাং, হোয়াইক্যং বিজিবির সদস্যদের কাছে কয়েক হাজার অনুপ্রবেশকারী আটকের বিষয়ে জানতে টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদের সরকারি মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার কল দেয়া হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এছাড়া কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল­াহ সরকার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা অস্বীকার করে বলেন, ঘুমধুম, তুমব্রু ও বালুখালীসহ তার নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাটালিয়নের আওতায় থাকা বিওপি সদস্যরা মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ১১ পুরুষ, ২০ নারী ও ৩৫ শিশুসহ ৬৬ জনকে অনুপ্রবেশকালে আটক করে স্বদেশে ফেরত পাঠিয়েছে।

অনুপ্রবেশ সম্পর্কে শরণার্থী ক্যাম্পসংশ্লিষ্ট ও অন্যদের দেয়া বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, বিজিবির সামনে দিয়ে কোনো অনুপ্রবেশ ঘটেনি।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন মিয়ানমারের জাতিগত নিপীড়ন থেকে প্রাণ রক্ষায় সীমান্ত পেরিয়ে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে স্বীকার করে বলেন, কী পরিমাণ অনুপ্রবেশ ঘটেছে- তার সঠিক হিসাব দেয়া যাবে না। তবে আমি স্বীকার করছি, প্রাণের মায়ায় ঝুঁকি নিয়ে অনেক রোহিঙ্গা মুসলিম অনুপ্রবেশ করে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন।

কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি আহ্বায়ক ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পে ৩১ হাজার ৭৫৯ জন নিবন্ধিত শরণার্থী অবস্থান করছে।

এছাড়াও নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরের পাশে গড়ে ওঠা বস্তিতে বাস করছে অনিবন্ধিত ৫০ থেকে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা। এছাড়াও পুরো জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা, যা বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে রয়েছে।

এর ওপর আবারো অনুপ্রবেশ দেশের জন্য অশনিসংকেত বয়ে আনবে। কারণ, অনেক রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে নানা অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে হত্যা, ডাকাতি, অপহরণসহ নানা অপরাধে জড়িয়েছে। তাই এসব রোহিঙ্গার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো দরকার বলে উল্লেখ করেন তিনি।



মন্তব্য চালু নেই