লাশ কেটে ৫৬ বছর
পিরোজপুর জেলার প্রাণকেন্দ্রের হরিজন পল্লীতে ৬৭ বছর ধরে বাস করছেন পান্নালাল দাস। এই ঘরেই কাটিয়ে দিয়েছেন ছোঁয়ার অযোগ্য অস্পৃশ্য জীবনের দীর্ঘ ৬৬ বছর। পেশায় তিনি একজন ডোম।
লাশকাটা ঘরের মৃত লাশের বুকে ছুরি চালানোর পেশা তার। জীবনের দীর্ঘ সময়ে লাশের কাটাছেড়া করলেও সমাজের চাপিয়ে দেয়া নিয়ম কাটতে পারেনি পান্না লালরা।
পান্না লাল বলেন, ‘মাত্র ১১ বছর বয়স থেকে তিনি লাশকাটা ঘরে তার বাবার সঙ্গে লাশের গায়ে ছুরি চালিয়ে আসছেন। এ পেশায় কেটে গেছে জীবনের ৫৬ বছর। এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় হাজার পুলিশ কেস হওয়া লাশের শরীর কাটাছেড়া করেছেন তিনি। এ কাজে কখনও তার হাত কাঁপেনি। এমনকি ভয়ও পাননি।’
এমন পেশা নিয়ে জীবন কাটানোর কথা ছিলনা তার। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে নারী, পুরুষ, হিন্দু, মুসলিম, কতো মানুষের শরীর কাটতে হয়েছে তাকে। অথচ এই কিশোর বয়সে বই-খাতা হাতে করে স্কুলে যাবার কথা ছিল তার। কিন্তু বংশ পরম্পরায় ডোমের ঘরে জন্ম নিয়ে ডোম হয়েই বেড়ে উঠতে হয়েছে তাকে।
পান্না আরও বলেন, ‘মেথর, ডোমদের ছেলে-মেয়েরা তখনকার দিনে স্কুলের কথা চিন্তাও করতে পারতো না। তাই বাবার হাত ধরে লাশ কাটার ঘর আর এই হরিজন পল্লীর কুঁড়েঘর পর্যন্ত ছিল চলাফেরার সুযোগ। ডোমের ঘরে জন্ম তাই ডোমের মেয়েকেই বিয়ে করে সংসার পেতেছি। তিনটি ছেলে জন্মেছে। বড় ও মেঝ ছেলে অন্য জেলায় এ পেশায় আছে। ছোট ছেলে চয়ন এখানে আমার সঙ্গে লাশ কাটাছেড়া করে। শিখিয়ে পড়িয়ে নিচ্ছি তাকে।’
নিজে পড়ালেখা করেননি আর ছেলেদেরও করালেন না কেন? জানতে চাইলে পান্না বলেন, ‘ডোমের চাকরিতে কী আর পড়ালেখা লাগে, আমরা গরীব, সমাজের মানুষ আমাদের সঙ্গে মিশতে চায়না বলে ওই দিকে যাইনি।’
হাজার হাজার লাশের শরীরে ছুরি চালালেন। অথচ নিয়ম ভেঙে নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারলেন না কেন? এ প্রশ্নের জবাবে পান্না লাল বলেন, ‘নিয়ম ভাঙতে এখনও মন চায়। সমাজের আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো সবার সঙ্গে মিলে মিশে বাঁচতে ইচ্ছে করে। কিন্তু অভ্যস্থ হয়ে যাওয়া জীবন ব্যবস্থা থেকে সহজে বের হওয়া যায়না। আপনারা আপানাদের মতো মানুষেরাই আমাদের আলাদাভাবে বাঁচতে বাধ্য করেন।’
পান্না লালের ছোট ছেলে চয়ন (১৭) জানায়, সরকারি চাকরি চাইলেই পাওয়া যায় না। তাই বাবার সঙ্গে লাশ কাটাছেড়া শিখি। যখন বাবায় বলে, এই পর্যন্ত সে ছয় হাজারের বেশি লাশ কেটেছে তখন সাহস পাই। এই পেশায় বাবা ছিল। আমারও থাকতে হবে এটাইতো নিয়ম। কিন্তু এই পেশা সত্যিই আমার ভালো লাগেনা। নিরুপায় হয়েই আমরা এই কাজ করি।
দুনিয়ায় মানুষের উঁচু-নিচু ভেদাভেদ বদলাচ্ছে, শুধু বদলাচ্ছেনা আমাদের! কিন্তু আমরাতো মানুষ। আর দশজনের মতোই মানুষ, আমাদের নিম্নশ্রেণীর জাতি হিসেবে দেখা হয়। বেকার জীবন বয়ে বেড়ানোর থেকে দু-চারটা লাশের শরীরে ছুড়িকাঁচি চালিয়ে যা আয় করি তাও খারাপ কী?
তারা জানান, অশিক্ষা, দারিদ্র, রোগ, শোক এদের জীবনে নিত্য সঙ্গী। এই পল্লীর মেয়েদের বাল্য বিয়ে হওয়ার কারণে অল্প বয়সে মা হয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকতে হয়। এ পল্লীর কোনো প্রতিবন্ধি সরকারি ভাতাও পায়না। সরকারি বেসরকারি কোনো সংগঠন, ব্যক্তি মালিকের সেবা ওদের দোর গোড়ায় পৌঁছেনি কোনো দিনই। শহরবাসীরা মেথরপট্টি রাস্তা থেকে হাঁটতে ইতস্তত বোধ করে। তাদের না পাওয়ার আর্তনাদ কারো কাছে পৌঁছায় না। ময়লা আবর্জনার স্তুপের মধ্যেই তাদের জীবন-যাপন।
এ প্রতিবেদকের কাছে ডোম পান্না লাল আর তার পরিবারের সদস্যরা দাবি তোলেন, দলিত জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের সাধারণ মানুষের মতো বাঁচার সুযোগ দেয়া হোক।
মন্তব্য চালু নেই