দেশজুড়ে বখাটেদের উৎপাত চরমে
অপরাধীদের বিচার না হওয়ায় বাড়ছে এমন নৃশংসতা
আবু রায়হান মিকাঈল : চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্কুলছাত্রী কণিকা ঘোষ, ঢাকার সুরাইয়া আক্তার রিসা ও মাদারীপুরের নিতু মণ্ডলের পর এবার সিলেটের খাদিজার ওপর বখাটে ও উত্ত্যক্তকারীর একই ধরনের হামলার ঘটনায় উৎকণ্ঠা বেড়েছে সারা দেশে। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, অপরাধীদের বিচার না হওয়ার কারণেই এমন ঘটনা বাড়ছে। প্রতিবাদ বা সামাজিক উদ্যোগ নিলে এসব ঘটনা এখনও প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে তার আগে দরকার অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর মিরপুর চিড়িয়াখানায় স্বামীর সাথে ঘুরতে গিয়েছিলেন নাসিমা আক্তার প্রিয়া (২২)। সেখানে প্রিয়া এসিড সন্ত্রাসের শিকার হন। এক বখাটে প্রিয়াকে লক্ষ্য করে এসিড ছুড়ে মারলে তার শরীরের বিভিন্ন স্থান ঝলসে যায়।
এভাবে খোদ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বখাটেদের হাতে একের পর প্রাণহানিসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা। এর মধ্যে শিশু ও কিশোরীও রয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, গত আট মাসে সারা দেশে বখাটেদের উৎপাতে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ১৬৯টি। এসব ঘটনায় আত্মহত্যা করেছেন তিনজন নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছে তিনজন ছাত্রী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় পাঁচজন পুরুষকেও খুন করেছে বখাটেরা। প্রতিবাদ করে লাঞ্ছিত হয়েছেন ৮২ নারী ও ১৬ পুরুষ। এসব ঘটনায় আঘাতের শিকার হয়েছেন ৫৭ পুরুষ। বখাটেদের উৎপাতে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে চার ছাত্রীর। তবে এই পরিসংখ্যান শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনার ভিত্তিতে। এর বাইরে আরো অনেক ঘটনা ঘটছে।
প্রিয়া, নিতু, রিসা, কণিকা ও খাজিদার মতো এমন অসংখ্য নারী আজ বখাটেদের নির্মমতার শিকার হচ্ছে।বখাটেপনার উৎপাত ক্রমান্বয়ে সমাজে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। অনেক ছাত্রী আবার নীরবে-নিভৃতে এসব অত্যাচার সহ্য করছে।
নিতু মণ্ডল : মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার নবগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী নিতু মণ্ডলকে (১৪) বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ (রোববার) সকালে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সে ওই গ্রামের নির্মল মণ্ডলের মেয়ে। হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামবাসী মিলন মণ্ডলকে আটক করে পুলিশে দেয়।
মিলন প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রায়ই ওই স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন। ঐদিন স্কুলে যাওয়ার পথে একটি নির্জন বাঁশবাগানের কাছে ওই স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালান মিলন। স্কুলছাত্রী বাধা দিলে মিলন তাকে অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেন। পরে স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যায় ওই স্কুলছাত্রী।
সুরাইয়া আক্তার রিসা : গত ২৪ আগস্ট বেলা পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর কাকরাইলস্থ উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামেন একটি টেইলার্সের কাটিং মাস্টার ওবায়দুল খান নামের বখাটে যুবক ছুরিকাঘাত করে সুরাইয়া আক্তার রিসা। ঘটনার গত ৬ মাস আগে মায়ের সঙ্গে ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সের বৈশাখী টেইলার্সে একটি ড্রেস সেলাই করতে দেয় রিসা। পরে দোকানের রিসিটে বাসার ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দেয়। সেই রিসিট থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে ওবায়দুল রিসাকে ফোনে উত্ত্যক্ত করতো। পরে ফোন নম্বরটি বন্ধ করে দিলে ওই বখাটে স্কুলে যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করতো রিসাকে। অবশেষে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় সুরাইয়া আক্তার রিসাকে।
কণিকা রানী ঘোষ : চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার স্কুলছাত্রী কণিকা রানী ঘোষসহ তার তিন বান্ধবী ২৭ মে ২০১৬ সকাল সোয়া ৯টার দিকে মহিপুর মোড়ে প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিল। এ সময় পথে মহিপুর ডিগ্রি কলেজের পেছনের সড়কে বখাটে আব্দুল মালেক পেছন থেকে তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ওই চার ছাত্রীকে কোপাতে থাকে। এ সময় কণিকা রানী ঘোষ মাটিতে পড়ে গেলে তার শরীরের একাধিক স্থানে হাসুয়া দিয়ে আঘাত করে মালেক। এতে কণিকার ডান হাতের কব্জি ঝুলে যায়। বখাটে মালেকের উপর্যুপরি হাসুয়ার আঘাতে অন্য তিনজন তারিন আফরোজ, মরিয়ম ও তানজিমাও গুরুতর আহত হয়। তাদের চিৎকারে স্থানীয় লোকজন ছুটে এসে তাদের উদ্ধার করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে। এসময় কর্তব্যরত চিকিৎসক কণিকা রানী ঘোষকে মৃত ঘোষণা করেন।
অবশেষে গত ৩ অক্টোবর সিলেটে খাদিজা আক্তার নার্গিস নামে সরকারি মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে কুপিয়েছে এক ছাত্রলীগ নেতা। পরীক্ষা দিতে সিলেটের এমসি কলেজে গিয়েছিলেন তিনি। পরীক্ষা শেষে ফেরার সময় এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে খাদিজাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন ছাত্রলীগের নেতা বদরুল আলম (২৬)। বদরুল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করছিলেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কেউ কেউ খাদিজাকে কোপানোর দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করেন। সেই ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনার নৃশংসতায় শিউরে উঠে নিজেদের মতামত প্রকাশ করছে হাজারো মানুষ।
বর্তমানে খাদিজা রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ৭২ ঘণ্টার নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। গত মঙ্গলবার খাদিজার দ্বিতীয় দফা অস্ত্রোপচার হয় স্কয়ার হাসপাতালে। তখন চিকিৎসক রেজাউস সাত্তার বলেছিলেন, ‘আমরা খুব সংকটাপন্ন অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে রিসিভ করেছি। এখন ইলেকটিভ ভেন্টিলেশনে আছেন (লাইফ সাপোর্ট)। তাঁর মাথায় ও দুই হাতে অসংখ্য কোপের ক্ষত। খুব জটিল অস্ত্রোপচার হয়েছে খাদিজার। এ ধরনের রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৫ শতাংশ। ৭২ ঘণ্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।’
মন্তব্য চালু নেই