জামায়াত-শিবিরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই জঙ্গিবাদ

জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন সংগঠনের গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বাড়তি নজরদারির প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সুশীল সমাজ। দেশের বেশ কয়েকটি হামলায় নিহত জঙ্গিদের অনেকেই জামায়াত পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিলেন বলেই বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে।

সর্বশেষ বাড্ডায় জামায়াতের একটি স্কুলে গোপন বৈঠক থেকে দলটির কয়েক জন নেতাকর্মী আটক হওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের’ কার্যক্রম চালানোর ধারণা করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সুশীল সমাজ। সে কারণে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট (ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ) পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

এর আগে গত ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরে ৫ নম্বর সড়কের তাজ মঞ্জিলের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশ অভিযান চালায়। এ সময় ৯ জঙ্গি নিহত হন। এদের দু’জনই জামায়াত-শিবির পরিচালিত দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিলেন। এর মধ্যে জঙ্গি সাব্বিরুল হক জামায়াত সমর্থক ব্যক্তিদের পরিচালিত আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চট্টগ্রাম ও ঢাকা) চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। রাকিবুল হাসান ওরফে রিগেন ২০১৫ সালে এইচএসসি পাস করে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য বগুড়া শহরে স্থানীয় জামায়াত-শিবির পরিচালিত ‘রেটিনা কোচিং’ সেন্টারে ভর্তি হন।

জামায়াত-শিবির নেতারা যেসব কোচিং সেন্টার পরিচালনা করছেন, সেগুলোর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ‘রেটিনা’ ‘ফোকাস’, ‘সাকসেস’, ‘ফেমাস’, ‘কনটেস্ট’, ‘কনসেপ্ট’, ‘প্রতিভা’, ‘প্রবাহ’, ‘রেডিয়াম’, ‘কনক্রিট ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিং সেন্টার’, ‘আল্টিমাম কোচিং সেন্টার’ অন্যতম। গত কয়েক বছর ধরে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারের মনোযোগে ঘাটতি ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন জঙ্গি হামলায় ওই সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে।

এছাড়াও সারাদেশে জামায়াতের আরও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ‘মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’, চিটাগাং ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট রিসার্চ ফাউন্ডেশন পরিচালিত ‘ইনডেক্স কোচিং সেন্টার’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল মালেক ফাউন্ডেশন পরিচালিত ‘ফোকাস’,কনক্রিট ফাউন্ডেশনের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড আর্কিটেকচার ভর্তি কোচিং ‘কনক্রিট’ ও প্রবাহসহ মোট পাঁচটি কোচিং সেন্টার শিবির নেতারা পরিচালনা করেন।

এদিকে, গত ১৯ আগস্ট রাজধানীর বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্টের ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে তল্লাশি চালিয়ে জামায়াতের ১৮ জনকে আটক করে পুলিশ। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী শামসুন্নাহার নিজামী স্কুলটির অধ্যক্ষ। রাজধানীতে এই স্কুলিটির আরও দুটি শাখা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোশতাক আহমেদ বলেন, ‘আটককৃতদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা গোপন বৈঠকের কথা স্বীকার করেছেন। শিশুদের প্রাথমিক লেভেলের এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তারা কী গোপন বৈঠক করেছিল, তা জানার চেষ্টা হয়েছে।’ তিনি বলেন,‘তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর সঙ্গে আরও কেউ জড়িত আছেন কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

উপ-কমিশনার (ডিসি) মোশতাক আহমেদ বলেন, ‘আমার এলাকায় আর কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কার্যক্রম হয় কিনা তাও নজরদারিতে রাখা হয়েছে।’

গত ১৪ আগস্ট র‍্যাবের হাতে আটক জেএমবির এক নারী উপদেষ্টা আকলিমা রহমান মনিসহ তিনজন মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। অপর দুইজনের নাম মৌ (২২) ও মেঘনা (২২)। তারাও মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। ঐশী (২৫) নামে একজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক।

জামায়াত পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে ৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গবেষক-সংগঠক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘১৯৭১ সালের গণহত্যাকারী মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী ১৯৭৯ সালে মানারাত কিন্ডারগার্টেন শুরু করেছিলেন; আজ তা বিশ্ববিদ্যালয়। জামায়াতের অসংখ্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুল রয়েছে যা জঙ্গি তৈরির কারখানা। সরকার এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারবে না, যতক্ষণ না সন্ত্রাসী দল হিসেবে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে পারবে।’

শাহরিয়ার কবির বলেন,‘গাছ না কেটে ডালপালা কাটলে তাতে গাছ আরও শক্তিশালী হয়। কয়েকজন শিক্ষার্থী ধরে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ করা যাবে না। যারা জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করছে, তাদের ধরতে হবে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট ও কারিকুলাম পরিবর্তন করতে হবে।’

জঙ্গি দমনে কৌশলপত্রের ওপর গুরুত্ব দিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘সরকারের একটা কৌশলপত্র বা ব্যবস্থাপত্র দরকার। আর তা হলো ’৭২-এর সংবিধান। ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।’

জামায়াত-শিবির দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে আছে। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। নীলক্ষেতে তাদের ফটোস্ট্যাটের দোকানও আছে বলে জানান শাহরিয়ার কবির। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার আগে তাদের ‘সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।খবর বাংলা ট্রিবিউনের।



মন্তব্য চালু নেই