সরদার কালোনি: যেখানে অভিযান চালায় না পুলিশ
সাম্প্রতিক গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরে জঙ্গি হামলা-নিহতের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে রাজধানীর মেস বাসাগুলোতে। এতে অনেকটা শঙ্কিত হয়ে কোনও কোনও বাড়ির মালিক বাসা ছেড়ে দিতে বলছেন মেস বাসিন্দাদের। এর ফলে দুর্ভোগে পড়ছেন মেসের বাসিন্দারা। এত কিছুর পরও স্বস্তিতে আছেন মতিঝিলের একটি মেসবাড়ির বাসিন্দারা। এই মেসের নাম ‘সরদার কলোনি’। এখানে ভাড়া থাকেন দেড়হাজার বাসিন্দা। যেখানে পুলিশ কোনও অভিযান চালায় না জানিয়েছেন ওই মেসের বাসিন্দারা। খবর বাংলা ট্রিবিউনের।
রাজধানীর কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে একটু দক্ষিণ দিকে এগুলে পশ্চিম দিকের একটি সরু গলিতে ঢুকলেই দেখা যাবে একটি গেট। সেই গেট দিয়ে ঢুকলেই একের পর এক ভবন। মোট আটটি ভবন সেখানে। এসব ভবনে কোনও পরিবার নেই, প্রতিটি ভবনের রুমই মেস। আর এই আটটি ভবন মিলেই ‘সরদার কলোনি’।
শুক্রবার সকালে সরদার কলোনির গেট দিয়ে ঢুকে বাম পাশেরই চারতলা একটি ভবনের প্রবেশ করতেই দেখা মেলে নাসির আহমেদের সঙ্গে। এক-দুই বছর নয়, প্রায় দশ বছর ধরে একই মেসে থাকছেন নাসির উদ্দিন। আলাপ করতে চাইলেই নিয়ে যান চারতলায় নিজের রুমে। এই দীর্ঘ সময়ের মেস জীবনের গল্প শোনান নাসির। ঘুরিয়ে দেখান মেসের বিভিন্ন অংশ।
নাসির উদ্দিন চাকরি করেন একটি ছাপাখানায়। বিবাহিত হলেও স্ত্রী, সন্তানরা থাকেন চট্টগ্রামে। তিনি বলেন, কম টাকা আয়, চাইলেই কি ঢাকা পরিবার নিয়ে থাকা যায়, কত খরচ? এই সরদার কলোনিতেই কেটে গেছে দশবছর। অন্য কোথাও বাসা খোঁজার কথা মনেই হয়নি। ভাড়া কম, পরিবেশ ভালো, সব মিলিয়ে ভালো আছি। আমি আগে নিচতলার একটি রুমে ছিলাম। এখন চারতলার এই রুমে তিনজন মিলে থাকি। আমি একা নই, দশ-বিশ বছর এখানে আছেন, এমন অনেক লোক পাবেন এখানে।
মেসে পুলিশের অভিযান হয় কিনা—জানতে চাইলে নাসির উদ্দিন বলেন, পুলিশ তো গতকালও এসেছিল। তারা প্রায় আসে, কথা বলে চলে যায়। এখানে এমন কোনও লোক থাকেন না, যাদের ধরে নিয়ে যেতে হবে। এখানে যারা থাকেন, তাদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যাই বেশি।
জানা গেছে, এই সরদার কলোনির বয়স প্রায় ৩৬ বছর। ঢাকার পঞ্চায়েত কমিটির সদস্য আফির উদ্দিন সরদারে নামেই করা হয় সরদার কলোনি। মতিঝিলের ১৩৫ নম্বর প্লটে আটটি ভবন রয়েছে। ভবনগুলো ১৩৫ (৪ তলা), ১৩৫/এ (২ তলা), ১৩৫/বি (৮ তলা), ১৩৫/সি (৬ তলা), ১৩৫/ডি (৫ তলা), ১৩৫/ই (৪ তলা), ১৩৫/এফ (৫ তলা), ১৩৫/জি (৫ তলা) নামেই পরিচিত। প্রতিটি ভবনে বিভিন্ন আকারের রুম রয়েছে। এসব রুমে আকারভেদে দুই থেকে পাঁচজন থাকতে পারেন। এছাড়া, প্রতিটি ভবনের প্রতি তলায় টয়লেট, রান্নাঘর, বাথরুম রয়েছে। প্রতিটি রুমের আমাক বিভিন্ন রকমের হলেও ডিজাইন একই ধরনের। প্রতিটি ভবনেই মাঝে রয়েছে বর্গাকার খোলা জায়গা। রুমের ভাড়া সর্বনিম্ন ৩ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। প্রত্যেক ভবনের দায়ত্বে আছেন একজন করে ম্যানেজার।
সরদার কলোনির প্রবেশ শুরুতেই চারতলা ১৩৫/ই ভবনের ম্যানেজার জয়নুদ্দিন সিকদার। সরদার কলোনির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখানেই আছেন তিনি। জয়নুদ্দিন সিকদার বলেন, এখানে মেসের সদস্যদের নিয়মকানুন মেনে থাকতে হয়। মেসে উঠলেই আইডি কার্ড, জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি দিতে হয়। আগে পুলিশ এসে এসব তথ্য নিয়ে যেত। এখন আমরাই দিয়ে আসি, নিজেরাও কপি সংরক্ষণ করি।
জয়নুদ্দিন সিকদার বলেন, আজ পর্যন্ত এই মেস থেকে কোনও আসামি খুঁজে পায়নি পুলিশ। দু’দিন আগেও ৫০ জনের মতো পুলিশ এসেছিল। মেসের সদস্যদের তথ্য যাচাই করে চলে গেছে।
জয়নুদ্দিন সিকদার বলেন, এখানে কোনও রুমে মেহমান এলে তাকে দু’দিনের বেশি থাকতে দেওয়া হয় না। মেহমান যদি অসুস্থ হন, তাহলে একমাস থাকতে পারবেন। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত লোকজন আসার সুযোগ নেই। মেসে চাকরিজীবীর সংখ্যাই বেশি। অল্প কিছু শিক্ষার্থী আছে। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে অভিভাবক না এলে মেসে উঠতে দেওয়া হয় না। ফেরিওয়ালা, ভিক্ষুককে কলোনিতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ফলে এখানের নিরাপত্তা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই।
১৩৫/জি ৫ তলা ভবনের রুমের সংখ্যা ৭২টি। এখানে প্রায় ২১৫ জন থাকেন বলে জানান ভবনটির ম্যানেজার ইউসুফ। তিনি বলেন, এই ভবনেও দীর্ঘ সময় ধরে আছেন এমন লোক আছে। কেউ সহজে রুম ছাড়ে না বলে মেসে খুব বেশি লোক পরির্তন হয় না।
প্রায় দশ বছর ধরে সরকার কলোনিতে আছেন সুখেন দাস। তিনি বলেন, আমি একটি ব্যাংকে চাকরি করি। পরিবারের সদস্যরা ঢাকার বাইরে থাকে। এখানের পরিবেশ ভালো, নিরাপদ।
মেসের সদস্যদের খাবারে ব্যবস্থা প্রসঙ্গে ১৫৩/বি ভবনের বাসিন্দা আব্দুর রউফ বলেন, রুমের সদস্যরা নিজেরা বাজার করে বুয়াকে দিয়ে রান্না করানো হয়। প্রতি তলায় রান্নাঘর আছে।
সরদার কলোনি প্রসঙ্গে মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, সরদার কলোনিতে থেকে নিয়মিত ভাড়াটিয়াদের তথ্য দেওয়া হয়। তারপরও আমরা খোঁজ-খবর রাখি, সঠিক তথ্য দেওয়া হচ্ছে কিনা। তবে এখন পর্যন্ত সেখান থেকে অপরাধী বা সন্দেহভাজন কাউকে আটক করা হয়নি।
মন্তব্য চালু নেই