‘আদালত সংবিধানের অঙ্গ, সরকারের অঙ্গ নয়’
২৭শে মার্চ ফের সুপ্রিম কোর্টে হাজির হতে হবে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে। যথাযথ না হওয়ায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের জবাব গ্রহণ না করে তাকে নতুন করে ব্যাখ্যা দাখিল করতে বলা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বেঞ্চ গতকাল এ আদেশ দেয়। এদিন সকালে দুই মন্ত্রী আদালতে হাজির হন। আদালতের কার্যক্রম শুরুর পর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। পরে আদালতের অনুমতিতে তারা বসেন।
খাদ্যমন্ত্রীর পক্ষে সিনিয়র অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, তিনি (কামরুল ইসলাম) আদালতে হাজির হয়েছেন। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনার কাছ থেকে আদালত অবমাননার কারণ দর্শানোর কোনো জবাব পাইনি। বাসেত মজুমদার বলেন, আজকেই একটি জবাব আমরা দাখিল করেছি। প্রধান বিচারপতি বলেন, দেখি জবাবে কি বলেছেন? তখন বাসেত মজুমদার দাখিলকৃত আবেদন থেকে জবাবের অংশ পাঠ করে বলেন, কামরুল ইসলাম বিশ্ব খাদ্য সংস্থার একটি আঞ্চলিক সম্মেলনে যোগদান এবং চিকিৎসা শেষে ১৬ই মার্চ দেশে ফিরেছেন। এর পরই আদালতের আদেশ মোতাবেক আপিল বিভাগে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।
একইসঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের উক্তি করা থেকে বিরত থাকবেন বলেও অঙ্গীকার করেছেন। প্রধান বিচারপতি আবেদনের ৫ নম্বর প্যারা পড়ার জন্য বাসেত মজুমদারকে বলেন। তখন ৫ নম্বর প্যারা উল্লেখ করে বাসেত মজুমদার বলেন, কনটেমনার একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকাররা এই মাটির সূর্য সন্তান ও কন্যাদের হত্যা করেছে। এই বিষয়টি স্মরণে আসায় তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা ছিল কষ্টকর। এজন্য ওই বক্তব্যের জন্য তিনি অনুশোচনা ও অনুতপ্ত বোধ করছেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, রাজনীতিবিদরা সংসদ ও টকশোতে বিচার কার্যক্রম নিয়ে নানা মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বিচারাধীন বিষয় নিয়ে দুজন মন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা ঔদ্ধত্যপূর্ণ। এ বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর নেপালে থাকাবস্থায় টেলিফোনে আমি মন্ত্রীকে বলেছি কেবিনেটে প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করতে। দেশে ফেরার আগেই দুই মন্ত্রীকে প্রেস কনফারেন্স করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলেছি। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী দুই মন্ত্রীকে বকাঝকা দিয়েছেন। এ বকাঝকায় কিছু হবে না। প্রেস কনফারেন্স করে ক্ষমা না চাইলে পরিণতি সাংঘাতিক খারাপ হবে। প্রধান বিচারপতি বলেন, বিমানবন্দর থেকে আমি বাসায় না গিয়ে সরাসরি আদালতে আসি।
পরের দিন গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দেয়া হবে। এর আগে কোনো চুল পরিমাণ বরখেলাপ হবে না, যদি নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রেস কনফারেন্স করে না করেন। মন্ত্রী সব বিচারকদের সঙ্গে কথা বলতে আসলেন। আমার বিচারকরা উনার সঙ্গে কথা বললেন না।
প্রধান বিচারপতি বলেন, এই আদালত সংবিধানের অঙ্গ, সরকারের অঙ্গ নয়। যেহেতু সংবিধানের অঙ্গ সেহেতু আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা দরকার। যে সিনিয়র জজ যিনি দায়িত্বে থাকেন, সে প্রধান বিচারপতিই হোক আর যেই হোক, তার প্রতি আমাদের প্রত্যেকেরই সম্মান থাকে।
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, মন্ত্রী মহোদয় শুধু প্রধান বিচারপতিকেই ছোট করেননি, গোটা বিচার বিভাগকে পায়ের নিচে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। তারা জানেন না বিচারাধীন বিষয় নিয়ে তারা কি ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন? আপনাদের জানতে হবে, এখানে প্রধান বিচারপতি একা কোনো রায় দেন না।
এ পর্যায়ে আপিল বিভাগের বিচারক বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, প্রধান বিচারপতি চাইলেও তার পক্ষে একা রায় দেয়া সম্ভব নয়। রায় প্রদানের আগে প্রধান বিচারপতিও একা জানেন না যে কি রায় হবে? সবার মতামত নিয়ে তাকে রায় ঘোষণা করতে হয়।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা জনকণ্ঠের রায়ে আদালত অবমাননার বিষয়ে পরিষ্কার বলে দিয়েছি। আইনজীবীর মাধ্যমে মন্ত্রীদের প্রশ্ন করি-আপনারা কি মীর কাসেমের রায় দেখেছেন? জনকণ্ঠের আদালত অবমাননার রায় পড়েছেন কি? মন্ত্রীরা মীর কাসেমের বিচারের রায়কে প্রভাবিত করতেই এই মন্তব্য করেছেন কিনা সেটা বুঝবো কেমনে? প্রধান বিচারপতি ও বিচার বিভাগকে স্ক্যান্ডালাইজ করেছেন কিনা? তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি যদি আদালত অবমাননার মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাহলে লাখ লাখ মামলা নিষ্পত্তির কি হবে? এ পর্যায়ে বাসেত মজুমদারকে বলেন, আপনার ব্যাখ্যা হয়নি। এটা আমরা প্রত্যাখ্যান করলাম। আপনার দাখিলকৃত জবাবের প্যারা ৫ সাংঘাতিক ঔদ্ধত্যপূর্ণ।
এ পর্যায়ে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি তো জনকণ্ঠের রায় পড়েছেন। সর্বোচ্চ আদালতের রায় মানতে কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কিনা? জবাবে রফিক-উল হক বলেন, এটা মানতে সবাই বাধ্য। প্রধান বিচারপতি বলেন, এটাই যদি হয় স্ক্যান্ডালাইজ অব দ্যা কোর্ট, বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপ এগুলো ক্রিমিনাল কনটেম্পট। ডাকাতি মামলার আসামিকে যেমন সাজা দেয়া হয় এ ধরনের কনটেম্পট করলেও একই রকমের সাজা দেয়া হয়। এটা জনকণ্ঠের মামলায় বলে দিয়েছি।
এটা জেনেও….প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি (মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী) স্বীকার করেছেন অপরাধ করেছেন। এই চ্যাপ্টারটা আমরা এখানেই শেষ করতে চাই। প্রতিটি টকশোতে যাবেন আর বাড়াবাড়ি করবেন। এটা আর দেখতে চাই না। আমরা বিচার করতে চাই। এরপর প্রধান বিচারপতি মন্ত্রীদের শপথ নেয়া সংক্রান্ত সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ পড়ার জন্য বলেন। তখন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সংবিধান থেকে ১৪৮ অনুচ্ছেদ পড়ে শোনান। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, এখন বলুন আপনি শপথ নিয়েছেন সংবিধান রক্ষার। আপনি যদি এই শপথ ভঙ্গ করেন আপনার পরিণতি কি হবে? কারণ আপনি স্বীকার করেছেন অন্যায় করেছেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা ইচ্ছে করেই রাত দশটা পর্যন্ত সেদিন মিটিং করেছি। কারণ সেদিন মন্ত্রী সাহেব বলে গেলেন, তখন পর্যন্ত আমরা মামলার সিদ্ধান্ত নেয়নি। পরের দিন নিয়েছি। আপনি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, সেটা জুডিশিয়াল নোটিসে নেয়ার আগেই আমরা একটা ম্যাসেজ দিয়েছিলাম। সেটা আপনার মক্কেল বুঝে ছিলেন কিনা?।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নেপালে হাইকমিশনের মোবাইল ফোনে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তখন কেবিনেট চলছিল। এ ছাড়া সব বিচারপতির উপস্থিতিতে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। এরপরও যদি না হয়, তাহলে আপনাদের সরকারেরর কেবিনেট কি রকম চলছে সেটা আপনারাই বোঝেন। পরের দিন সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করেছিলাম।
প্রধান বিচারপতি বলেন, দেশ চলতে হলে সংবিধান রক্ষা করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী দেশ চলবে। তারা কত ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। এমনকি ওখানে একজন প্রসিকিউটর ছিলেন, তিনি নাকি রায় নিয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যানকে দেখিয়েছেন। উনি বলেছেন রায় ঠিক আছে। আপনারা সুপ্রিম কোর্টকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
কোর্ট অব রেকর্ডের বাইরে আমরা রায় দিতে পারি না। আমরা সংবিধানের চুল পরিমাণ ব্যত্যয় করতে পারি না। আপনি সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছেন। আপনার অপরাধ স্বীকার করা আর জনকণ্ঠের সাংবাদিক বা কোনো একজনের অপরাধ স্বীকার করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আপনার অপরাধ আর একজন সাধারণ নাগরিকের অপরাধ এক নয়। দোষ স্বীকার করার পর কি হতে পারে বলুন? প্রধান বিচারপতি বলেন, একজন অপরাধীকে যখন কাঠগড়ায় এনে বলা হয়-তুমি দোষী না নির্দোষ?
তখন ওই আসামি দোষ স্বীকার করছি ক্ষমা করেন-এ পর্যায়ে আদালত কি তাকে খালাস দেবেন, না কি করবেন? জবাবে ব্যারিস্টার রফিক -উল হল বলেন, সিম্পলি পানিশমেন্ট দিতে পারে। তিনি বলেন, আমি তো অন্যায় করেছি বলেই নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছি।
এরপর বাসেত মজুমদার বলেন, ক্ষমা যখন চেয়েছি তখন দোষ স্বীকার করেই চেয়েছি। এখন পুরো বিষয়টি আদালতের হাতে। বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, আমাদের প্রথা হচ্ছে ক্ষমা দুই লাইনে চাইতে হয়। হোয়াট ইজ দিস? আপনারা বিশাল ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা জানি বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা কারা। তাদের ভূমিকা কি সেটাও আমরা অবগত। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি যদি ওই মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতেন তাহলে দেশে রায়ট লেগে যেত। জানেন না কি কথা বলেছেন আপনারা। পুরো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল হয়ে যেত। এরপর বাসেত মজুমদার বলেন, আমরা যথাযথভাবে জবাব দাখিল করতে চাই। এজন্য সময় প্রয়োজন। এরপর প্রধান বিচারপতি ২৭শে মার্চ দিন ধার্য করে দেন। একইসঙ্গে ওইদিন খাদ্যমন্ত্রীকে জবাব দাখিলের নির্দেশ দেন।
বাসেত মজুমদারের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনার মক্কেলকে সুরক্ষা দিতে না পারলে আদালতে আসবেন না। আপনারা যতই ক্ষমতাধর হোন না কেন আইন কিন্তু সোজা পথে চলবে। আমরা অনেক সহ্য করেছি। সংবিধান রক্ষায় যে কোনো আদেশ দিতে আমরা পিছপা/কুণ্ঠাবোধ করবো না, সে আপনি যেই হোন না কেন।
প্রধান বিচারপতি ও বিচারাধীন মামলার বিষয়বস্তু নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য দেয়ায় গত ৮ই মার্চ আপিল বিভাগের ফুল কোর্ট আদালত অবমাননার অভিযোগে দুই মন্ত্রীকে তলব করেছিল। একইসঙ্গে আদালত অবমাননার দায়ে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না তার ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। সূত্র: মানবজমিন
মন্তব্য চালু নেই