প্রশাসনে তিন লাখ পদ শূন্য: আটকে আছে বহু নিয়োগ

বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন দফতরে ৩ লাখ ২ হাজার ৯০৪টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে ৬৯ হাজার ৫০১টি পদ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির। বাকিগুলো অন্যান্য গ্রেডের সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন অনেক প্রতিষ্ঠানে তিন লাখ পদ শূন্য রয়েছে; কিন্তু এসব পদে নিয়োগ করা হচ্ছে না। অনেক পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা শেষ হচ্ছে না। অনেকক্ষেত্রে নিয়োগের সব প্রক্রিয়া শেষ হলেও নিয়োগপত্র প্রদান আটকে আছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষা নেয়ার পর ফলাফল ঘোষণা বন্ধ রাখা হয়েছে।
গত ৩১ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংসদে জানান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন দফতরে ৩ লাখ ২ হাজার ৯০৪টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে ৬৯ হাজার ৫০১টি পদ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির। বাকিগুলো অন্যান্য গ্রেডের। তবে এ হিসাব ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ। এখন এ ধরনের শূন্য পদের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, যেসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হওয়ার কথা সেসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কোটারি স্বার্থ, ক্ষেত্রবিশেষে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, তদ্বিরের চাপ, নিয়োগ বাণিজ্য প্রভৃতি কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে রয়েছে। আবার দুর্নীতির উদ্দেশ্যে কৌশলে নিয়োগে ধীরগতির পথ অবলম্বন করা হচ্ছে। এসব কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানে বারবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করেও ফলাফল প্রকাশ করা হচ্ছে না।

ফলে চাকরি প্রত্যাশীদের হয়রানি বাড়ছে। পোস্টাল অর্ডার, পে-অর্ডার, যাতায়াত ইত্যাদিতে চাকরি প্রার্থীদের পকেট কাটা গেলেও কর্তৃপক্ষের গায়ে লাগছে না। অনেকের আবেদনের বয়স পেরিয়ে যাওয়ায় সমাজ ও সংসারে বোঝা বাড়ছে। অনেকে বিপথগামী হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কাজে জড়িয়ে পড়ছে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

জানা গেছে, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীনে বিভিন্ন প্রকল্প ও রাজস্ব খাতে প্রথম থেকে শুরু করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কয়েক হাজার পদের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুই মাস আগে। ফলাফল প্রস্তুত করা হলেও তা প্রকাশ করা হচ্ছে না। নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে এখন দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা চলছে। স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদে নিয়োগের সকল প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে চার মাস আগে।
ফল ঘোষণার আভাস মিলছে না। স্থানীয় সরকার বিভাগে ২০১৪ সালে পৌরসভার সচিব পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছিল। লিখিত পরীক্ষার তারিখও ঘোষণা করা হয়েছিল; কিন্তু হঠাত্ সেই প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। এখনো চাকরি প্রত্যাশীরা প্রতিক্ষায় কবে ‘নিয়োগ বাক্স’ খোলা হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ২০০৪ সালে অফিস সহকারীসহ দুইটি পদে নিয়োগের জন্য প্রথম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। অধিদপ্তর সূত্র মতে, এতে আবেদনকারী ছিলেন প্রায় দেড় লাখ। ওই বছর ২১ জুলাই প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয় এবং ২৬ অক্টোবর অজ্ঞাত কারণে ফল ঘোষণা না করে নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। কারণ হিসাবে জানা গেছে, তদ্বিরের বিশাল চাপ সামলে নিয়োগ কার্যক্রম চালাতে পারছিলেন না দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

পরবর্তীতে অবশ্য একই পদের জন্য ২০০৮, ২০১১ ও ২০১২ সালে প্রথম বিজ্ঞপ্তির ধারাবাহিকতায় পুনরায় চাকরির জন্য দরখাস্ত আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। এতে বলা ছিল- পূর্বে যারা আবেদন করেছেন তাদের আবেদনের প্রয়োজন নেই। এতে নতুন করে আরো প্রায় ৫০ হাজার প্রার্থী আবেদন করেন। ২০১১ সালের ২১ জুলাই মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়; কিন্তু ফল ঘোষণা হয়নি।

এরপর আরো দুই বছর পর ২০১৪ সালের ৯ মে সর্বশেষ মৌখিক পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়; কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার গুজবে তা-ও স্থগিত রাখা হয়। এরপর এ বিষয়ে আর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অবশ্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, নানা কারণে এসব পদে নিয়োগ দেয়া হয়নি। মন্ত্রণালয়ের প্রায় প্রতিটি সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে অচিরেই একটা সমাধান হবে।

এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রায় দুই হাজার পদে নিয়োগ স্থগিত হয়ে আছে প্রায় চার বছর ধরে। ২০১২ সালের ৯ মার্চ এক হাজার ৯৬৫টি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। ২০১৩ সালের জুন মাসে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

ওই বছরেরই ২৮ জুন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করার কথা ছিল। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বড় অংকের বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠায় শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে তা স্থগিত রাখা হয়। তবে ওই নিয়োগের সূত্র ধরে বিভিন্ন চাকরি প্রার্থীর সাথে যোগাযোগ করে একটি অসাধু চক্র কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত বছরের শেষ দিকে ৪৯ জন জনবল নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ঢাকা বোর্ড। এরপর থেকেই এ পদে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন কর্মচারী ইউনিয়নের নেতারা। এই নিয়োগ নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠায় তা বাতিল করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। পরে আবারো বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলে নতুন করে ফের নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। কর্মকর্তাদের সাথে কর্মচারীদের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। ফলে আবারো নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে বোর্ড কর্তৃপক্ষ।

সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকের পদ রয়েছে ১০ হাজার ৬টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৭শ পদ শূন্য। সহকারী শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদার নিয়োগ বিধি চূড়ান্ত না হওয়ায় পিএসসি এসব পদে নিয়োগ দিতে পারছে না। এছাড়া সরকারি কলেজে শিক্ষকদের পদ শূন্য আছে ৩ হাজারেরও বেশি।

অন্যদিকে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনো অর্ধলক্ষ শিক্ষকের পদ শূন্য। এর মধ্যে নতুন জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শূন্য পদের সংখ্যা ২৩ হাজার ৫৪১ জন। শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়া পিএসসি ও কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের সমন্বয়হীনতায় বহু পদ শূন্য রয়েছে সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটগুলোতে। সূত্র: ইত্তেফাক



মন্তব্য চালু নেই