মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে ব্যয় হবে কত?

জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে সরকারি-বেসরকারিভাবে আগামী তিন বছরে মালয়েশিয়ায় ১৫ লাখ কর্মী পাঠাবে বাংলাদেশ। নতুন এই পদ্ধতিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোও কর্মী পাঠাতে পারবে, যার অনুমোদন আজ সোমবার মন্ত্রিসভা দিয়েছে।

কিন্তু এই কর্মী পাঠাতে জনপ্রতি কত টাকা ব্যয় হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মালয়েশিয়ায় জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী প্রতি খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা এবং এই টাকা কর্মীকেই বহন করতে হবে।

তবে কর্মী প্রতি এই ব্যয় নিয়ে আজ মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম বলেছেন, মালয়েশিয়ায় যেতে কর্মী প্রতি ব্যয় হবে ৩৪ থেকে ৩৭ হাজার টাকা এবং এই অর্থ নিয়োগকর্তাই বহন করবে।

এর আগে গত মাসে অবশ্য প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রতি ব্যয়ের বিষয়ে বলেছিলেন, ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা ব্যয় হতে পারে।

জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (কর্মসংস্থান) কাজী আবুল কালাম বলেছেন, ‘মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে মাথাপিছু খরচ পড়বে ৪৫ হাজার টাকা। এই টাকা কর্মীকেই বহন করতে হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান আংশিক খরচ বহন করবে। তবে তার পরিমাণ কতো সে বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।’

কবে নাগাদ কর্মী প্রেরণের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী কালাম বলেন, আমরা আশা করছি আগামী এক মাসের মধ্যেই এর আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে। দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হবে।

তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের আরেক যুগ্মসচিব আবদুর রউফ বলেন, ‘মালয়েশিয়া যেতে একজন কর্মীকে খরচ করতে হবে ৩৪ থেকে ৩৭ হাজার টাকা। এরমধ্যে বিমান ভাড়া, রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভিস চার্জ, মেডিকেল চার্জ রয়েছে। এর বাইরে যে টাকাটা খরচ হবে সেটি বহন করবে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। ’

এর বাইরে কতটাকা খরচ হতে পারে যেটা নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বহন করবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটি আরও ১০ হাজার টাকার মতো হতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, মালয়েশিয়ায় জনশক্তি প্রেরণে বেসরকারিভাবে শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ রাখায় আমরা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। শ্রমিক প্রেরণে সরকার যে টাকা নির্ধারণ করে দেবে সেটিই আমরা মেনে নেবো। সাধারণ মানুষ যেন উপকৃত হয় সে দিকে আমাদের সকলের লক্ষ্য রাখতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কত টাকা নির্ধারণ হবে সেটা যেন বায়রার সঙ্গে আলোচনা করে সরকার ঠিক করে, যাতে সাধারণ মানুষ এবং ব্যবসায়ীরা উভয়ই লাভবান হতে পারে।

তিনি বলেন, কর্মী প্রেরণের সুযোগ যেন বায়রার সকল সদস্য রিক্রুটিং এজেন্সি পায় সেই দিকে সরকারের দৃষ্টি রাখা দরকার। কেউ যেন একতরফাভাবে লাভবান না হয়।

বায়রার সভাপতি বলেন, সরকার নির্ধারিত টাকায় যেন সবাই কর্মী পাঠায়- এটি সরকারকে মনিটরিং করতে হবে, যেন কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

মালয়েশিয়ায় জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী পাটানোর বিষয়টি গত ৯ নভেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করার কথা ছিল। সমঝোতা স্মারকের খসড়ার বিভিন্ন দিক ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করতে সময় নেয়ায় সেটি ওই সময় প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

২০০৯ সালে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। তৎকালীণ প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের (বর্তমানে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে) নিরলস চেষ্টায় তিন বছর পর মালয়েশিয়া কর্মী নিতে রাজি হয়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় (জিটুজি) কর্মী পাঠাতে ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়। জিটুজিতে মালয়েশিয়া সরকারের চাহিদার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার কর্মী পাঠাত। পাঁচ বছরে পাঁচ লাখ কর্মী পাঠানোর কথা থাকলেও ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে নয় হাজার কর্মী নেয় মালয়েশিয়া।

তৎকালীন মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের দৃঢ় নেতৃত্বে জনশক্তি রপ্তানি খাতে শৃঙ্খলা ফিরিযে আসে এবং নামমাত্র মূল্যে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পায় কর্মীরা।

সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। গত বছরের এপ্রিলে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের অর্ধশত গণকবর আবিষ্কৃত হয়। নিহতের সবাই সাগরপথে মানব পাচারের শিকার। হাজারো মানুষের মৃত্যুতে সারাবিশ্বে সমালোচনার ঝড় ওঠে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মার্চ পর্যন্ত আগের ১৫ মাসে ৭৮ হাজার মানুষ সাগরপথে পাচার হয়েছে। তাদের অন্তত আট হাজার পথে নিহত হয়েছেন।

সমালোচনার মুখে মালয়েশিয়া শ্রমবাজার উন্মুক্ত করার ঘোষণা দেয়। গত বছরের জুনে মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়, কর্মী পাঠানোর দায়িত্ব বেসরকারি খাতে (বিটুবি) ছেড়ে দেওয়া হবে। মালয়েশিয়ান বেসরকারি নিয়োগকারীদের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিকারকরা কর্মী পাঠাবেন।

দুই মাস পর এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে দুই দেশ। গত আগস্টে মালয়েশিয়ান প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর শেষে জানানো হয়, বিটুবি নয়, সরকারি নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি রপ্তানিকারকদের যুক্ত করে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানো হবে।

জিটুজি পদ্ধতিতে শুধু বনায়ন খাতে (প্ল্যান্টেশন) কর্মী নিত মালয়েশিয়া। জিটুজি প্লাসে সেবা, নির্মাণ, কারখানা, কৃষি, বনায়নসহ মোট ১৫টি খাতে কর্মী পাঠানো হবে।

জিটুজির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় ২০১২ সালে যেতে প্রায় ১৫ লাখ কর্মী নিবন্ধন করেন। আগে যারা নিবন্ধন করেছেন, এবার তাদের থেকেই কর্মী পাঠানো হবে বলে জানা গেছে। তবে নতুন করে নিবন্ধনের সুযোগ রয়েছে।

প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৩০ হাজার ৪৮৩ কর্মী বৈধপথে মালয়েশিয়ায় কাজ করতে গেছেন। চলতি বছরের প্রথম মাসে গেছেন আরও সাড়ে ১২ হাজার কর্মী। জিটুজি প্লাস কার্যকর হলে এ সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মালয়েশিয়ান সরকারের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশি অবৈধভাবে বসবাস করছেন। বাংলাদেশিসহ সব অবৈধ অভিবাসীকে বৈধতা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির সরকার। ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হবে।



মন্তব্য চালু নেই