নিজামীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
মানবতা বিরোধী অপরাধে মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) ধারায় মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মোট ১৬টি ঘটনায় অভিযোগ আনা হয়েছিল।
নিজামীর বিরুদ্ধে দেয়া রায়ে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগের প্রতিটিতে আলাদাভাবে তার ফাঁসির রায় হয়েছিল এবং ১, ৩, ৭, ৮ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। আর ৫ নম্বর অভিযোগে সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করেননি প্রসিকিউশন। ৯ থেকে ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত ছিল না। আজ (বুধবার) আপিল বিভাগের রায়ে ১, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে তাকে খালাস দেয়া হয়। ২, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে।
নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো
প্রথম অভিযোগ
পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালাতেন। একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা তাকে অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউসের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ১০ জুন তাকে ইছামতী নদীর পাড়ে অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে হত্যা করা হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগ
একাত্তরের ১০ মে সকাল ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে বাউশগাড়িসহ দু’টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ করে রাজাকাররা।
তৃতীয় অভিযোগ
একাত্তরের মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। নিজামী ওই ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতেন।
চতুর্থ অভিযোগ
পাবনার করমজা গ্রামে নিজামীর নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় হাবিবুর রহমান নামে একজনকে হত্যা করা হয়। ৮ মে নিজামীর রাজাকার ও আলবদর বাহিনী করমজা গ্রাম ঘিরে ফেলে ৯ জনকে হত্যা করে। রাজাকার বাহিনী একজনকে ধর্ষণসহ বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
পঞ্চম অভিযোগ
একাত্তরের ১৬ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে নিজামীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতেরবাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে ২১ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। এ সময় বাড়ি-ঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
ষষ্ঠ অভিযোগ
নিজামীর নির্দেশে ২৭ নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে অভিযান চালায় রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা। তারা গ্রামের ডা. আব্দুল আউয়াল ও তার আশেপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করে।
সপ্তম অভিযোগ
৩ নভেম্বর মধ্যরাতে নিজামীর তথ্যমতে পাকিস্তানি বাহিনী পাবনার বৃশালিখা গ্রাম ঘিরে ফেলে সোহরাব আলীকে আটক করে তার স্ত্রী ও সন্তানদের সামনে হত্যা করে।
অষ্টম অভিযোগ
৩০ আগস্ট নিজামী নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে গিয়ে সেখানে আটক রুমী, বদি, জালালদের হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনা দেন।
নবম অভিযোগ
নিজামীর দেয়া তথ্যে পাকিস্তানি বাহিনী পাবনার বৃশালিখা গ্রাম ঘিরে ফেলে ৭০ জনকে হত্যা ও ৭২টি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে।
দশম অভিযোগ
পাবনার সোনাতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র কুণ্ডু প্রাণ বাঁচাতে ভারতে চলে যান। নিজামীর নির্দেশে রাজাকাররা তার বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়।
১১ নম্বর অভিযোগ
একাত্তরের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়োজিত সভায় নিজামী বলেন, পাকিস্তান আল্লাহর ঘর। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তিনি প্রিয় ভূমির হেফাজত করছেন। দুনিয়ার কোনো শক্তি পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না।
১২ নম্বর অভিযোগ
২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল মাদানীর স্মরণসভায় নিজামী বলেন, পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে শত্রুরা অস্ত্র হাতে নিয়েছে। তিনি পাকিস্তানের শত্রুদের সমূলে নির্মূল করার আহ্বান জানান।
১৩ নম্বর অভিযোগ
৮ সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ছাত্রসংঘের সভায় নিজামী বলেন, হিন্দুস্তানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে রাজাকার, আলবদররা প্রস্তুত।
১৪ নম্বর অভিযোগ
১০ সেপ্টেম্বর যশোরে রাজাকারদের প্রধান কার্যালয়ে এক সুধী সমাবেশে নিজামী প্রত্যেক রাজাকারকে ইমানদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আল্লাহর পথে কেউ কখনো হত্যা করে, কেউ মারা যায়। এসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ছাত্রসংঘের সদস্য, রাজাকার ও অন্যদের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের উসকানি ও প্ররোচণা দেন নিজামী।
১৫ নম্বর অভিযোগ
একাত্তরের মে মাস থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প ছিল। নিজামী প্রায়ই ওই ক্যাম্পে গিয়ে রাজাকার সামাদ মিয়ার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়।
১৬ নম্বর অভিযোগ
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আল-বদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের তত্কালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে।
এ রায়ের পর ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করার সুযোগ রয়েছে আপিল বিভাগের। রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে গেলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ভিক্ষাই একমাত্র পথ খোলা থাকবে।
মন্তব্য চালু নেই