পালিয়ে বেড়াচ্ছে অর্ধ-শতাধিক রাজাকার

গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশে-বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় অর্ধ-শতাধিক রাজাকার। এদের মধ্যে ছয় জনের যুদ্ধাপরাধের মামলায় সাজা হয়েছে, অন্যদের বিরুদ্ধে বিচার চলছে ট্রাইব্যুনালে।

এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় তৃণমূল রাজাকার সংগঠকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তারা আত্মগোপণে চলে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচার চলাকালে আসামিরা পালিয়ে থাকলে বিচারপ্রার্থীর কাছে মনে হয় না যে তারা বিচার পেয়েছেন। তবে আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে আইনগত কোন বাধা নেই।

এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা সানাউল হক বলেন, মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করার আগেই অধিকাংশ আসামি আত্মগোপনে চলে যাচ্ছেন। তদন্ত সংস্থাকে যদি গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়া হত তাহলে আসামিরা পালানোর সুযোগ পেত না।

তিনি বলেন, ‘মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলার আসামিদের মধ্যে বিচারকে এভয়েড করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেটা বন্ধ করতে তদন্ত সংস্থাকে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়া উচিত।’

পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পলাতক যারা:

রাজাকারআবুল কালাম আযাদ (বাচ্চু রাজাকার): মৃত্যুদন্ডের সাজা নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ (বাচ্চু রাজাকার)। ২০১৩ সালের  ২১ জানুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় আবুল কালাম আযাদকে। এটা ছিল ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়।

রায় ঘোষণার কয়েক মাস আগেই  ভারতে পালিয়ে যান বাচ্চু রাজাকার। ওই সময় তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার। প্রথমে ভারতে আছে এমন তথ্যে দেশটির সঙ্গে যোগাযোগ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে ভারত  তার কোনো হদিস দিতে পারেনি।

আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিন: মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যার  দায়ে ২০১৩ সালে ৩ নভেম্বর  আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের অনুপস্থিতিতেই ট্রাইব্যুনাল তাদের মৃত্যুদন্ড দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আশরাফুজ্জামান খান যুক্তরাষ্ট্রে এবং চৌধুরী মাঈনুদ্দিন যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। তারা দুজনই মাইনরিটি কমিউনিটির নেতা।  দুজনের বিরুদ্ধেই ইন্টারপোলের রেড নোটিশ ইস্যু রয়েছে।

এই দুজনকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কাজ চলছে। তবে জনস্বার্থে এর চেয়ে বিস্তারিত কিছুই বলা যাবে না।

রাজাকারজাহিদ হোসেন খোকন: ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত স্ব-ঘোষিত রাজাকার, ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র ও পৌর বিএনপির সহ-সভাপতি জাহিদ হোসেন খোকনও বিচার শুরুর আগেই দেশ থেকে পালিয়ে যান।  বর্তমানে স্ব-ঘোষিত এই রাজাকার  সুইডেনের স্টকহোমে বড় ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে রয়েছেন।

ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার:  জাতীয় পার্টির প্রাক্তন এমপি পিরোজপুরের ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার আমৃত্যু কারাদন্ড নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। জানা গেছে, এই আসামি রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়।

রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মো. হাসান আলী: পলাতক থাকা অবস্থায় কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মো. হাসান আলীর বিচার সম্পন্ন হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো যুদ্ধাপরাধের দায়ে আদালত গত ৯ জুন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

গত বছরের ৩ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। আদালতের আদেশ সত্ত্বেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এখনো তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

জামালপুরের ছয় রাজাকার: মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলায় জামালপুরের আট জনের মধ্যে ছয় আসামী পলাতক রয়েছেন। এরা হলেন- মো. আশরাফ হোসেন, অধ্যাপক শরীফ আহমেদ ওরফে শরীফ হোসেন, মো. আব্দুল মান্নান, মো. আব্দুল বারি, হারুন, মো. আবুল কাসেম।

গত ২২ জুলাই পলাতক জামালপুরের ছয় রাজাকারকে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল।

কক্সবাজারের ১৪ রাজাকার: মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় কক্সবাজারের ২০ রাজাকারের মধ্যে ১৪ জন পলাতক রয়েছে।এই মামলার  আসামীরা হলেন, সালামত উল্লাহ খান, মৌলভী জকরিয়া শিকদার(৭৮), মো: রশিদ মিয়াবিএ (৮৩), অলি আহমদ (৫৮), মো: জালাল উদ্দিন (৬৩), মোলভী নুরুল ইসলাম (৬১), মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম সাবুল (৬৩), মমতাজ আহম্মদ (৬০), হাবিবুর রহমান (৭০), মৌলভী আমজাদ আলী (৭০), মৌলভী আব্দুল মজিদ (৮৫), বাদশা মিয়া (৭৩), ওসমান গণি (৬১), আব্দুল শুক্কুর (৬৫), মৌলভী সামসুদ্দোহা (৮২), মো. জাকারিয়া (৫৮), মো. জিন্নাহ ওরফে জিন্নাত আলী (৫৮) মৌলভী জালাল (৭৫), আব্দুল আজিজ (৬৮) ও রমিজ হাসান। তাদের বিরুদ্ধে আগামী ২৩ নভেম্বরের মধ্যে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

এদের মধ্যে সালামত উল্লাহ খানসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

কিশোরগঞ্জের চার রাজাকার: মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উঠার পর থেকে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মো. নাসিরউদ্দিন আহমেদ , কিশোরগঞ্জের রাজাকার কমান্ডার গাজী আব্দুল মান্নান, হাফিজ উদ্দিন ও আজহারুল ইসলাম এই চার আসামি পলাতক রয়েছেন। গত ১ জুন পলাতক  এই চারজনকে আত্মসমর্পণের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।  এই চার জনের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, আটক, লুণ্ঠন, নির্যাতনের সাতটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।

রাজাকারনেত্রকোনার পাঁচ রাজাকার: মনবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ মাথায় ‍নিয়ে নেত্রকোনার সাত আসামির মধ্যে পাঁচ জন পলাতক রয়েছেন।

এ মামলায় পলাতক আসামিরা হলেন- শেখ মো. আব্দুল মজিদ ওরফে মজিদ মাওলানা, মো. আব্দুল খালেক তালুকদার, কবির খান, মো. নুরুদ্দিন ওরফে রুদ্দিন এবং ছালাম বেগ।

আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমার সময় বাড়িয়ে আগামী ১৫ জানুয়ারি জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

যশোরের ১১ রাজাকার: মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক যশোর-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির নেতা মাওলানা সাখাওয়াত হোসেনের সহযোগী ১১ রাজাকার পলাতক রয়েছেন।

এই আসামীরা হলেন- যশোরের মো. ইব্রাহিম হোসেন, মো. বিল্লাল হোসেন, শেখ মো. মজিবুর রহমান, মো. আব্দুল আজিম সরদার, মো. আজিম সরদার, কাজী ওয়াহেদুল ইসলাম, মো. লুৎফর মোড়ল, মো. আব্দুল খালেক মোড়ল, মো. আকরাম হোসেন, ওজিয়ার মোড়ল এবং মশিয়ার রহমান। ইতিমধ্যে এই ১১ জন রাজাকারকে গ্রেফতার করতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই রাজাকার: মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর পলাতক রয়েছেন পলাতক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সৈয়দ মো. হুসাইন ওরফে হোসেন (৬৪) এবং মো.মোসলেম প্রধান (৬৬)।

তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে তদন্ত সংস্থা।

নোয়াখালীর দুই রাজাকার:  মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন নোয়াখালীর আবুল কালাম ওরফে এ কে এম মনসুর ও মো. আব্দুল কুদ্দুস।

পলাতকদের ধরতে মনিটরিং সেল গঠন:

রাজাকারযুদ্ধাপরাধের অভিযোগ নিয়ে বিদেশে পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

যেসব আসামি বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব বা রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছে তাদের শনাক্ত করে ফিরিয়ে আনার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। পলাতকরা কোন দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে অবস্থান করছে সেই তথ্য জানার চেষ্টা চলছে।

সুত্র জানায়, সরকার বিদেশে পলাতক যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে আনতে অনেক আগ থেকেই জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতেও অনেক আগে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করেছে সরকার।

 



মন্তব্য চালু নেই