কিশোরগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নের পটভূমি
আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও, আমি একটা শিক্ষিত জাতি উপহার দিব। নেপোলিয়ানের এই বিখ্যাত উক্তিটির মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষিত মায়ের গুরুত্ব কত বেশী তা সহজইে অনুময়ে । প্রত্যেকটি শিশুর জীবনের প্রথম শিক্ষক হলেন তার মা। তাই প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মায়ের অবদান যেমন অস্বীকার করার কোন উপায় নেই, তেমনি সুশিক্ষিত জাতি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের বিকল্প নেই। কেননা শিক্ষার ভিত্তি মজবুত না হলে সুশিক্ষা অর্জনের অন্যান্য ধাপগুলো অপুর্ণাঙ্গ থেকে যেতে পার। আর শিশুর জীবনের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণকে বুঝায়। এদিক থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাকে ভিত্তি হিসেবে বা শিক্ষাস্তরের মা বলে আখ্যায়িত করা হয়।
প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে ভাবনা শুরু হয় সিভিল সার্ভিস যোগদানের পর পরই। এ ভাবনাকে সামান্য কাজে লাগানাের সুযোগ ঘটে বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাড়ে তিন বছর উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায়। সিভিল সার্ভিসের ২৬ টি ক্যাডারের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের একটি মডিউলে ( বাংলাদেশঃ এক্সপ্লোরিং পোটেনশিয়ালিটিজ) প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে মাঠ সংযুক্তির সময় একটি করে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে পাঠানো হত। কেন্দ্রে ফেরার পর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক জনাব শ্যামল কান্তি ঘোষকে প্রতিটি কোর্সেই অতিথি বক্তা হিসেবে এনে ফিডব্যাক শুনানো হতো। ঐ সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ও একবার এসেছিলেন। তাঁরা প্রশিক্ষণার্থীদের মুখে মাঠ পর্যায়ের সমস্যাসমূহ শুনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছেন। এমনও হয়েছে বিপিএটিসিতে ক্লাশে প্রশিক্ষণার্থীর মুখে শিক্ষক সংকটের কথা শুনে সচিব মহোদয় জেলা শিক্ষা অফিসারকে ফোন করে একদিনের মধ্যে স্কুলে শিক্ষক পাঠিয়েছেন। ৫৫তম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সে ২৬০ জন প্রশিক্ষণার্থীকে মাঠ সংযুক্তিকালে নিজ গ্রামে নিজের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে পড়েছিল) পাঠানো হয়েছিল। অতঃপর ফিডব্যাক সেশনে মহাপরিচালক মহোদয় প্রশিক্ষণার্থীদেরকে অনুরোধ করেছিলেন তারা যেন প্রত্যেকেই চাকুরীকালব্যাপী নিজের বিদ্যালয়টির উন্নয়নের জন্য কাজ করে যায়। অধিদপ্তরের তরফ থেকে সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। সংশ্লষ্টি সকল অফসি এবং বদ্যিালয়ে পত্রও জারি করেছেন।
প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরাসরি কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে পদায়নের পর থেকে। নীলফামারী জেলাধীন কিশোরগঞ্জ উপজেলায় যোগদানের পর বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শন করে দেখা গেল প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে শিক্ষক সংকটই একমাত্র সমস্যা নয়। এমনও দেখা গেছে বিদ্যালয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর রয়েছে কিন্তু শিক্ষক নেই। আবার বিদ্যালয় চলাকালীন শিক্ষা অফিসে বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের আনাগোনা। দু’ চারজন শিক্ষককের কাছে জানতে চাইলে তারা জানান নানা সমস্যার কথা। বিস্মিত হতে হলো সমস্যাগুলো থেকে উত্তোরণের জন্য তাদের নিজস্ব কোন পরিকল্পনা নেই জেনে। কালবিলম্ব না করে উপজেলার সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে নিয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করা হলো। কর্মশালায় সমস্যা ও সম্ভাবনা অনুসন্ধানে প্রথমেই SWOT analysis এর মাধ্যমে কিশোরগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষার Strengths বা শক্তি, সামর্থসমূহ, weaknesses বা দূর্বলদিকসমূহ , opportunities বা সুযোগ সুবিধাসমূহ এবং threats বা হুমকিসমূহ চিহ্নিত করা হয়। উল্লেখ্য যে, Strengths এবং weaknesses হলো সাধারণত প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ এবং opportunities ও threats আসে বাইরে থেকে। অবশ্য এটিও কোন ধরা বাধা নিয়ম নয়, আপেক্ষিক বিষয়, কখনও কখনও উল্টোটাও হতে পারে।
উপজেলার সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সাথে সোয়াট এনালাইসিস করা হয়। এতে বেড়িয়ে আসে অনেক অজানা দূর্বলদিকসমূহ। শতকরা ৬০ ভাগ শিক্ষক সময়মত বিদ্যালয়ে আগমন-প্রস্থান করেন না। পাঠ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছাড়াই শ্রেণি অধিবেশন পরিচালনা করেন ৮০% শিক্ষক । Contents যেভাবে Design করা হয়েছে সেভাবে পাঠদান করা হয় না। যেমনঃ দলীয় কাজ, ডায়ালোগ, অনুশীলন প্রভৃতি ঠিকমত হয় না।হোম ভিজিট ঠিকমত করা হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে শুধু মাত্র কাগজে কলমে হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে শিক্ষকের স্নেহসুলভ বা সন্তানতুল্য আচরণের অভাব। লেখা পড়ায় দূর্বল এবং অমনযোগী ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি বিশেষ যত্নের অভাব। অনেক বিদ্যালয়ে একশিপ্টে কøাশ করার মত পর্যাপ্ত শ্রেণি কক্ষ, ছাত্র-ছাত্রীদের বসার বেঞ্চ বা আসবাব পত্র নেই। স্টান্ডার্ড ক্লাশ পরিচালনার জন্য ছাত্র-ছাত্রী অনুপাতে শিক্ষক নেই। বেশির ভাগ শিক্ষক উপজেলা শহর বা তার আসে পাশে পোস্টিং নিয়েছেন ফলে প্রত্যন্ত এলাকার বিদ্যালয়সমূহে প্রায় ৩০% শিক্ষকের পদশূণ্য।
বিরাজিত দূর্বলদিকসমূহ দুর করে শতভাগ শিশু ভর্তি, ঝড়েপড়ারোধ ও প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস, শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলীর সহায়তায় একটি স্মার্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে শিশু জরিপের মাধ্যমে স্কুলে যাওয়ার উপযোগী বয়সের শিশুদের শতভাগ স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করা, ঝড়ে পড়া শিশুদেরকে পুণরায় বিদ্যালয়ে ভর্তি করে নিয়মিত খোঁজ খবর নেয়া হয়। এছাড়া বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের তালিকা তৈরি, সহায়ক উপকরণ যেমনঃ হুইল চেয়ার, হেয়ার এইড, চশমা প্রভৃতি উপকরণ বিতরণ ও বিদ্যালয়মুখী করা হয়। পিছিয়ে পড়া/ দূর্বল শিশুদের জন্য স্পেশাল পাঠদানের ব্যবস্থা করা ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সময়মত আগমন প্রস্থান নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেক বিদ্যালয়ে একটি ছক করে দেয়া হয়। উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার প্রতিদিন ছক পূরণ করেন। প্রধানশিক্ষকগণ মোবাইলে ফোন করে অথবা এসএমএস এর মাধ্যমে মোট উপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা জানান। সহকারী শিক্ষা অফিসার মাঝে মাঝে ক্রস চেক করেন যাতে করে কোন শিক্ষক অতিরঞ্জিত সংখ্যা সরবরাহ না করেন। মাসের শেষে গড় করে যাদের উপস্থিতি শতকরা ৮৫ ভাগের উপর তাদের নিয়ে উপবৃত্তির তালিকা প্রণয়ন করেন। এ প্রক্রিয়ায় ভাল ফল পাওয়া যায়, স্কুলসমূহে উপস্থিতি বেড়ে যায়। কেননা প্রধান শিক্ষকগণ এক ধরণের মানসিক চাপে থাকেন যেন শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কমতে না পাড়ে। হোমভিজিট ঠিকমত হয়, ঝড়েপড়া রোধ হয়। ফলে এ উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে ১০০% সফলতা হাতছানি দিচ্ছে।
এছাড়াও উপজেলা পর্যায় শ্রেষ্ঠশিক্ষক ও শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় নির্ধারণপূর্বক পুরস্কার বিতরণ, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের মান উন্নয়ন ও পড়াশুনায় মনোযোগী হওয়ার জন্য ক্লাস্টারভিত্তিক অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে প্রতি শনিবার সাপ্তাহিক পরীক্ষা ও মূল্যায়ন হচ্ছে। শিক্ষারমান উন্নয়নে বছরে ৩ টি মডেল টেস্ট গ্রহণ ও মূল্যায়ন, বাড়ির কাজ হিসেবে সকল শিক্ষার্থীর বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা অনুশীলন, সহঃপাঠ্যক্রমিক বিষয়ে পাঠদান (চারুকারু, শারীরিক শিক্ষা, সংগীত, বিতর্ক, কুইজ) এবং এসব বিষয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রম নিশ্চিতকরণসহ মেডিকেল চেকআপ, রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ইতিমধ্যে ৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীর রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে কার্ড প্রদান করা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাপ্তাহিক ও মডেল টেষ্ট পরীক্ষার ফলাফল গ্রেডিং পদ্ধতিতে প্রকাশ করা হচ্ছে।
মা সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশ, ঝড়েপড়ারোধ, শিশু বিবাহরোধ, স্যানিটেশন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও আকর্ষণীয় শ্রেণি অধিবেশন পরিচালনার একটি মডেল নাটিকা “মেঘের কোলে রোধ হেসেছে” রচনা করে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে মঞ্চস্থ করা হয়েছে। ডিজিটাল মেলা ২০১৪ এবং ২০১৫ উদযাপন উপলক্ষে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন এবং বিজয়ীদের মাঝে কম্পিউটার শিক্ষা বই বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া উপজেলার মাসিক সভায় প্রত্যেক কর্মকর্তা উপজেলার যে কোন ২টি স্কুলের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে । তাঁরা শিক্ষার পরিমাণগত ও গুণগতমান নিশ্চিত করার জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করবেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক কর্মকর্তাগণ কাজ করে যাচ্ছেন। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আগমন প্রস্থান সময়মত হচ্ছে, ছাত্র-শিক্ষক প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাশে আসছে, দূরের স্কুলের শিক্ষক সংকট কিছুটা কেটেছে, কন্টেন্ট ডিজাইন মোতাবেক দলীয় কাজ, কথোপকথন, রোল প্রভৃতির ব্যবহার হওয়ায় শ্রেণি অধিবেশনসমূহ আকর্ষণীয় হয়েছে, উপস্থিতি বেড়েছে। মোটকথা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে আমরা মনে করি। একটি সচেতন ও উন্নত জাতি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভবনের ভিত্তি দূর্বল হলে যেমন ভবন ঝুকিপূর্ণ হয় ঠিক তেমনি প্রাথমিক শিক্ষার ভিত দূর্বল হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন ঝুকিপূর্ণ হয়ে ওঠতে পারে। আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের সঠিকরুপে গড়ে তোলার জন্য, শিশুদের মানসিক, মানবিক, আধ্যাত্বিক, আবেগিক মেধা বিকাশ ও অপার কৌতূহল জাগ্রত করার দায়িত্ব সকলের। কাজেই বিদ্যালয় পর্যায়ে সোয়াট এনালাইসিস (Strengths, weaknesses, opportunities এবং threats) করতে হবে। চিহ্নিত Strengths এর মাধ্যমে weaknesses কে overcome এবং opportunities এর মাধ্যমে threats কে kill করার জন্য একটি সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক। স্থানীয়ভাবে উক্ত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। কেননা প্রাথমিক শিক্ষা শিশুদের স্মৃতি, চেতনা, কল্পনা, স্বপ্ন, মৌলিক গুণাবলীকে জাগ্রত করে । আদর্শ নাগরিক, ভদ্রতা-সভ্যতা, কৃষ্টি-কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য, দেশপ্রেম, ন্যায়পরায়নতা সর্বোপরি সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষার অবদান অসামান্য। এ শিক্ষা কারো একক কোন বিষয় নয় সার্বজনীন । কাজেই দলমত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সকলে একাট্টা হয়ে পরিকল্পনা মোতাবেক প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে এগিয়ে আসতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন হলে সুশিক্ষিত জাতি গঠন ও দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। আর সহজতর হবে ২০১৫ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়নের বিশ্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষমাত্রা।
লেখক :
মোঃ সিদ্দিকুর রহমান
উপজেলা নির্বাহী অফিসার
কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী।
E-mail : [email protected]
মন্তব্য চালু নেই