সরকারকে ডোবাচ্ছে নেতা এমপিদের অপকর্ম
রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে নানা উন্নয়ন কর্মসূচি ও পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। অনেক ক্ষেত্রেই এর ইতিবাচক অর্জন আছে। কিন্তু সব সাফল্যই ম্লান হতে বসেছে ক্ষমতাসীন দলেরই কিছুসংখ্যক নেতা ও সংসদ সদস্যের বেপরোয়া দুর্নীতি আর অপকর্মে। এতে একদিকে যেমন সরকার সমালোচনার মুখে পড়ছে, একই সঙ্গে আওয়ামী লীগও সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছে, এদের রুখতে না পারলে সরকারের লক্ষ্যপূরণ ব্যাহত হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম, টাঙ্গাইল-৩ আসনের আমানুর রহমান খান রানা, কক্সবাজার-৪ আসনের আবদুর রহমান বদি, চট্টগ্রাম-১৫ আসনের আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী, ময়মনসিংহ-৩ আসনের ক্যাপ্টেন মজিবুর রহমান ফকির, মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সুকুমার রঞ্জন ঘোষ, একই জেলার আওয়ামী লীগ সভাপতি মহিউদ্দিন, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিন চাকলাদার, জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সোলায়মান আলী, খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোস্তফা রশিদী সুজা, রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী লাগামহীন অনিয়ম, দুর্নীতি, দখলবাজিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্ত।
জামায়াতেই ঘরবসতি
চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভীই এখন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ। জামায়াত ঘরানার এই নেতা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলে নাম লিখিয়ে সংসদ সদস্য হন। এর পরই তিনি জামায়াতিদের কাছে টেনে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করতে শুরু করেন। এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই সেখানে মারামারি হচ্ছে।
সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন আবুল কাশেম চৌধুরী। তিনি বড় হাতিয়া সেনানাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতিও। স্কুলটির প্রধান শিক্ষকও ছিলেন তিনি। পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদকে কেন্দ্র করে নদভীর সঙ্গে মতভেদের কারণে তাঁকে এক রাত থানায় আটকে রাখা হয়। তিনি বলেন, ‘নদভী আসায় এখন আর দল করি না। নতুন কমিটিতেও পদ নেইনি। দল করতাম মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক কারণে। যদি সে চর্চারই সুযোগ না থাকে, তাহলে থেকে কী লাভ?’
উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘এমপি সাহেবের দাপটে পুরনো কর্মীরা সংখ্যালঘু হয়ে গেছি। তাঁর আশপাশে এখন জামায়াত নেতাকর্মীদের ভিড়। উপজেলা নির্বাচনে নদভী বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী শাওনকে প্রভাব খাটিয়ে জিতিয়ে এনেছেন।’
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, নদভীর হাতে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা লাঞ্ছিত হয়েছেন। বিরুদ্ধে কথা বলায় বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ মিয়াকে একদিন ধরে থানায় নিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেন এমপি। আরেক মুক্তিযোদ্ধা জালাল খলিফাকেও পুলিশ দিয়ে হেনস্তা করান। জালাল খলিফার ছেলে ছাত্রলীগ নেতা বাপ্পীকে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।
নদভীর সাম্প্রদায়িক আচরণে ক্ষুব্ধ স্থানীয় সংখ্যালঘুরাও। সম্প্রতি চরতি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কোরআন তিলাওয়াতের পর গীতাপাঠের ঘোষণা দেন সঞ্চালক। স্থানীয় আওয়ামী লীগকর্মী সুমন গীতাপাঠ শুরু করলে নদভী ধমক দিয়ে তাঁকে থামিয়ে দেন। তাঁর স্ত্রী চট্টগ্রাম মহানগর ইসলামী ছাত্রী সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। নদভী এখনো জামায়াত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দেননি। তাঁর শ্বশুর মোমিনুল হক চৌধুরী জামায়াতের মজলিসে শুরার সদস্য। নদভীর সঙ্গে জামায়াতের প্রয়াত আমির গোলাম আযমের ঘনিষ্ঠতার অনেক ছবি গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে।
তবে এসব অভিযোগ সত্য নয় জানিয়ে নদভী বলেন, ‘নেতাকর্মীদের পুলিশ দিয়ে নির্যাতনের বিষয়ে কিছু জানি না। আর গীতা পাঠ করতে না দেওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। কিছু লোক সুমনকে মঞ্চে উঠতে বাধা দেয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার স্ত্রী কখনোই জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না। জামায়াতে যোগ না দেওয়ার কারণে শ্বশুরের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই।’
বাপ-বেটার শাসন
ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম ও তাঁর ছেলে মাজহারুল ইসলাম সুজনের বিরুদ্ধে নির্যাতন-নিপীড়ন ও সংখ্যালঘুদের জমি দখলের এন্তার অভিযোগ। দিনাজপুরের বালিয়াডাঙ্গীর পাড়িয়া ইউনিয়নে রনবাগ ইসলাম টি এস্টেট কম্পানি লিমিটেড নামের একটি চা বাগান গড়ে তুলেছেন দবিরুল। ১০৬ একর আয়তনের ওই বাগানের মাঝখানে স্থানীয় অকুল চন্দ্র সিংয়ের ২১ বিঘা, ভাকারাম সিং ও জনক চন্দ্র সিংয়ের ২৭ বিঘা, থোনরাম সিংয়ের ২৪ বিঘা, ক্ষুদনলালের ২৪ বিঘাসহ ১০ পরিবারের চা বাগান ও আবাদি জমি আছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব জমি দখলের চেষ্টা করছেন দবিরুল ও তাঁর ছেলে। এর জন্য জমির মালিকদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
গত ১৯ জুন সুজনের নেতৃত্বে টি এস্টেট কম্পানির তত্ত্বাবধায়ক একরামুল হকসহ বেশ কয়েকজন অকুল চন্দ্র সিং, ভাকারাম সিং ও জনক চন্দ্র সিংয়ের ওপর হামলা চালান। তাঁরা চা বাগানের জমি সুজনের নামে লিখে দেওয়ার জন্য জোর করে স্ট্যাম্পে অকুল চন্দ্রের স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করেন।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও দবিরুল ও তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের জমি দখল ও নির্যাতনের বিষয়টি উঠে আসে। তবে এসব ঘটনাকে ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন দবিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘জমি দখল ও সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ঘৃণ্য চক্রান্ত। বিষয়টি নিয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে। পরে একজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে আহ্বায়ক করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তারাও ঘটনার সত্যতা পায়নি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করি না। সংখ্যালঘুদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। আমার বড় ছেলের বউও হিন্দু ধর্মাবলম্বী।’
পারিবারিক শাসন
সরকারের ভাবমূর্তি ডোবানো আরেক সংসদ সদস্য টাঙ্গাইল-৩ আসনের আমানুর রহমান খান রানা। তিনি ও তাঁর পরিবারের কয়েক সদস্যের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমি দখলের অভিযোগ পুরনো। এই পরিবার দলের এক নেতাকে খুন করে সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম হয়। টাঙ্গাইলের জনপ্রিয় নেতা ফারুক আহম্মেদ হত্যায় এমপি ও তাঁর তিন ভাই- মুক্তি, বাপ্পা ও কাঁকনের নাম আসে। তাঁদের সম্পৃক্ততার কথা জানিয়ে জবানবন্দি দেন ফারুক হত্যায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা। এর পর থেকেই আমানুর রহমান পলাতক।
রানা পরিবারের দাপটে টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতাও কোণঠাসা। মাদক, জুয়া, হাউজি, দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ এই পরিবারের হাতে। কয়েক বছরেই তাঁরা বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন।
আমানুর রহমান রানা আত্মগোপনে থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি।
ইয়াবায় নষ্ট রাজনীতি
রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে তরুণদের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। অথচ এই তরুণদের ধ্বংসকারী মাদক ইয়াবা চোরাচালানের অঘোষিত গডফাদার আবদুর রহমান বদি। কক্সবাজার-৪ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মানবপাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। এসব কুকর্মের বদৌলতে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বদি ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে, যা বর্তমানে বিচারাধীন। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিক লাঞ্ছনার অভিযোগও আছে। গত ১২ আগস্ট তিনি উখিয়া উপজেলার প্রকৌশলী (এলজিইডি) মোস্তফা মিনহাজের অফিসে ঢুকে তাঁর কলার ধরে মারধর ও গালিগালাজ করেন। এর আগেও তিনি এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন।
প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার মাস্টার
দাম্ভিক আচরণ, অশালীন কথাবার্তাসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সমালোচিত ময়মনসিংহ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) মজিবুর রহমান ফকির। সরকারের বিগত মেয়াদে তিনি স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী হয়েই নিজের দাপট দেখাতে শুরু করেন। এখন প্রতিমন্ত্রিত্ব না থাকলেও তাঁর আচরণ বদলায়নি।
গত সংসদ নির্বাচনে তাঁর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নাজনীন আলম। এতে ভীষণ চটেন মজিবুর রহমান। নির্বাচনী প্রচারণাকালে নাজনীনের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। একাধিক নির্বাচনী জনসভায় নাজনীনকে অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করেন ফকির। স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা ভাংনামারী ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুজ্জামান ছোটনের মাথা প্রকাশ্যে ন্যাড়া করে দেওয়া হয়।
গত ২২ এপ্রিল এমপির অপছন্দের ব্যক্তিকে অতিথি করায় ডৌহাখলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বিল্লাল হোসেনকে কলতাপাড়ায় এমপির ব্যক্তিগত কার্যালয় ‘সেবালয়’-এ নিয়ে পেটানো হয়। বিল্লালকে স্কুল থেকে ফকির নিজেই তাঁর গাড়িতে করে সেবালয়ে নিয়ে যান। পরে মাথা ন্যাড়া করার জন্য নাপিত ডাকার কথা শুনে ওই শিক্ষক অজ্ঞান হয়ে গেলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ফকিরের ভাতিজা আতাউর রহমান ফারুকের নেতৃত্বে এমপি-বিরোধীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালানো নিত্যদিনের ঘটনা সেখানে।
দখলবাজি আর ক্ষমতার দাপট
মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য সুকুমার রঞ্জন ঘোষের বিরুদ্ধে দখলবাজির বিস্তর অভিযোগ। তিনি তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সিরাজুল ইসলামকে স্কুল, কলেজ, মসজিদের জমি দখলে সহায়তা করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ একাধিক যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার প্রমাণ আছে। গত ২৬ জুলাই এমপির ঘনিষ্ঠ যুবলীগ নেতা নেছার উল্লাহ সুজন ও ছাত্রলীগ নেতা অনিক ইসলামের বাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। এতে ক্ষুব্ধ সংসদ সদস্য সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শামসুজ্জামানকে অপসারণের জন্য ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেন। এসব ঘটনায় দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা এমপির ওপর ক্ষুব্ধ। শ্রীনগর উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়েও বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন সুকুমার রঞ্জন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ঘোষিত কমিটির বিরুদ্ধে তিনি পাল্টা কমিটি গঠন করান। এ নিয়ে বিবাদ চলমান।
জানতে চাইলে সুকুমার রঞ্জন ঘোষ বলেন, ‘কোনো অভিযোগই সত্য নয়। বিশেষ একটি মহল এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। কেউ প্রমাণ দিতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেব।’
ছাত্রলীগের পাল্টা কমিটি গঠনের বিষয়টি স্বীকার করে সুকুমার বলেন, ‘নিয়মবহির্ভূতভাবে কেন্দ্রীয় এক নেতা ফেসবুকে কমিটি ঘোষণা করে। তাতে যোগ্যরা বাদ পড়ায় পাল্টা কমিটি গঠন জরুরি হয়ে পড়ে।’
পরিবারে বন্দি রাজনীতি
মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক মো. মহিউদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ লুৎফর রহমানের পরিবারের নিয়ন্ত্রণে চলছে জেলার রাজনীতি। জেলা কমিটিতে দুই নেতার পরিবারের আটজন সদস্য রয়েছেন।
মহিউদ্দিন ১৯৯১ সাল থেকে সভাপতি এবং শেখ লুৎফর রহমান ১৯৯৬ থেকে সাধারণ সম্পাদক। জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০১৪ সালের ২১ জুন। ওই সম্মেলনে তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে অনুগত ও পছন্দের লোক দিয়ে কমিটি গঠন করেন। এতে ত্যাগী অনেক নেতা বাদ পড়েন। বর্তমান কমিটির সদস্য আছেন মহিউদ্দিনের বড় ছেলে ফয়সাল বিপ্লব ও ছোট বোনের জামাই মতিউল ইসলাম। ছোট বোন ফরিদা আক্তার মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। তিনি জেলা মহিলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। ছোট ভাই আনিছুজ্জামান আনিস জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও সদর উপজেলার চেয়ারম্যান। ভাতিজা আক্তারুজ্জামান রাজিব জেলা যুবলীগের সভাপতি।
লুৎফর রহমানের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মেয়ে লতিফা রেহনুমা আছেন জেলা কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে। ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলমও রয়েছেন কমিটিতে।
মহিউদ্দিনের কারণে সাবেক সংসদ সদস্য ইদ্রিস আলী দল থেকে দূরে সরে গেছেন। মুন্সীগঞ্জে জেলা আওয়ামী লীগের কোনো কার্যালয় নেই। মহিউদ্দিনের বাড়ি থেকেই পরিচালিত হয় সব কর্মকাণ্ড।
জানতে চাইলে অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেন লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের আত্মীয়রা যোগ্যতা ও দলে অবদানের কারণে কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। আর যাঁদের মূল্যায়ন করা হয়নি, তাঁদের তো দল থেকে বহিষ্কার করা উচিত ছিল। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে দলের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকেন।’
ক্যাডারবাহিনী লেলিয়ে ত্রাস
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিন চাকলাদার এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন পুরো জেলার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে। তাঁর কথার বাইরে গেলে রেহাই নেই কারো। পাত্তা পান না জেলার শীর্ষ নেতা থেকে এমপিরাও। দলীয় নেতাকর্মী নয়, বিশাল ক্যাডারবাহিনী নিয়ে যশোর চালান তিনি। বিএনপির সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামের অনুসারীরাও আখের গোছাতে ভিড়ে গেছে তাঁর পক্ষে। ফলে প্রকৃত আওয়ামী লীগাররা ভীষণ ক্ষুব্ধ।
২০১০ সালে যশোর সদর থানা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রিপন হত্যার ঘটনায় শাহিন চাকলাদারের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। কয়েক মাস আগে ইসালি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন হত্যার পেছনেও শাহিনের হাত রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। উদীচী বোমা হামলায় জড়িত সাবেক যুবদল নেতা আবুল খায়ের এখনো বেপরোয়া শাহিনের প্রশ্রয়ে। এই আবুল খায়ের সাংবাদিক মুকুল হত্যারও আসামি। বেনাপোল সীমান্ত থেকে শুরু করে পুরো যশোর শহর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মাদক ব্যবসা চলছে শাহিন চাকলাদারের প্রশ্রয়ে। তাঁর হয়ে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন শাহরুল। এই শাহরুল ছাত্রলীগ নেতা রিপন হত্যার চার্জশিটভুক্ত আসামি। ফেনসিডিল ও ইয়াবা ব্যবসায়ী জাকির হোসেনও চাকলাদারের সব সময়ের সঙ্গী। চাকলাদারের ভাই হিসেবে পরিচিত পন্টু চাকলাদারের হাতেও আছে পুরো এলাকার মাদক সম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ।
জানতে চাইলে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, দলীয় বা রাজনৈতিক কারণে ওই সব খুনের ঘটনা ঘটেনি। এর নেপথ্যে রয়েছে ব্যক্তিস্বার্থ। এর জন্য দল দায়ী নয়, দায়ী কিছু ব্যক্তি। তাঁদের শনাক্ত করা এবং শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব প্রশাসনের।
চলছে বিএনপির শাসন
জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্রশাসক এস এম সোলায়মান আলী। এমপি থেকে শুরু করে জেলার সভাপতি- কারো পাত্তা নেই তাঁর কাছে। বরং বিএনপি নেতাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো।
সোলায়মান আলীর প্রশ্রয়ে জয়পুরহাট কবজা করে রেখেছেন বিএনপির সাবেক নেতা সৈয়দ রানা হুদা ও গোলাম মর্তুজা শিপলু। একসময় এঁরাই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছেন। রানা হুদাকে পৌর যুবলীগের কমিটিতে রাখা হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। গোলাম মর্তুজাকেও আওয়ামী লীগ নেতা বানিয়েছেন সোলায়মান।
দখলই শেষ কথা
খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোস্তফা রশিদী সুজার বিরদ্ধে এলাকায় দখলবাজির অভিযোগ রয়েছে। তাঁর মদদে ভাই এস এম মোয়াজ্জেম রশিদী দোজা সম্প্রতি বটিয়াঘাটা উপজেলায় ৩০০ বিঘা আয়তনের মাছের ঘের দখল করেছেন। খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন আমিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জবিউল্লাহ।
জামায়াত-বিএনপির পৃষ্ঠপোষক
রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী জামায়াত-বিএনপির প্রধান পৃষ্ঠপোষক এখন। তিনি রাজশাহীর শাহ মখদুম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামায়াতসংশ্লিষ্ট মনিরুজ্জামান স্বাধীন। একসময়ের শিবির নেতা স্বাধীনকে ওমর ফারুক নানা ধরনের সহযোগিতা করেন। শাহ মখদুম মেডিক্যাল কলেজে নিয়মবহির্ভূতভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করায় কলেজটিকে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গত ১৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহম্মদ মিজান উদ্দিনকে হুমকি দেন ওমর ফারুক চৌধুরী। এ বিষয়ে জানতে ওমর ফারুক চৌধুরীর মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া দেননি। কালের কণ্ঠ
মন্তব্য চালু নেই