সংসদে বিদায়ী ভাষণে যা বললেন লতিফ সিদ্দিকী
সংসদের ১৩৩ ও টাঙ্গাইল-৪ আসন থেকে পদত্যাগ করলেন দল ও মন্ত্রিত্ব থেকে বহিষ্কৃত আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে দীর্ঘ বক্তব্য শেষে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে দশম সংসদের সপ্তম অধিবেশনে লতিফ সিদ্দিকী অধিবেশন কক্ষে আসেন। কারো সঙ্গে কথা না বলে নিজ আসনে গিয়ে বসেন। স্পিকারের অনুমতি নিয়ে লতিফ সিদ্দিকী ফ্লোর নেন। তিনি এসময় একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এরপর পদত্যাগের চূড়ান্ত ঘোষণা দেন। একটি সাদা খামে পদত্যাগপত্র পৌঁছে দেয়া হয় অধিবেশন কক্ষেই স্পিকারের কাছে। স্পিকার এসময় চিঠিটি খুলে দেখেন। বিটিভি ও সংসদ টিভিতে এ সময় সংসদের অধিবেশন সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দেয়ার আগেই লতিফ সিদ্দিকী তার ওয়াদা অনুযায়ী মঙ্গলবার পদত্যাগ করেন। বহু ঘটনার মধ্য দিয়ে সংসদে উপস্থিত হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি লিখিত বক্তব্য পড়ার অনুমতি নেন স্পিকার থেকে।
লতিফ সিদ্দিকীর লিখিত বক্তব্য
লিখিত বক্তব্যে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, প্রথমে আমি বলে নিই, আমি মুসলমান আমি বাঙালি, আমি আওয়ামী লীগার। এই পরিচয় মুছে দেয়ার মতো শক্তি পৃথিবীর কারো নেই। কারণ এই আমার চেতনা, আমার জীবনবেদ, প্রাণের রসদ, চলার সুনির্দিষ্ট পথ। যে যাই বলুন, প্রচার করুন, সিদ্ধান্ত নিন এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটবে না। আমি মানুষ বলেই আমার ভুল ভ্রান্তি আছে, ক্রুটি আছে। কিন্তু মনুষত্বের স্খলন নেই, মানবতার প্রতি বিশ্বাস হারাই না, যত বড় আঘাতই আসুক ধৈর্যহারা হই না। আমি বিশ্বাস করি আঁধার মানেই আলোর হাতছানি, রাষ্ট্র নিপীড়ন করলেও আমি ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে মেনে নিয়েই তা মোকাবেলা করলাম।
আমি অভিযোগের টুকরি নিয়ে সংসদে দাঁড়াইনি। ভালোবাসার মহিমা বিতরণ করতে সৌহার্দ্য আর প্রীতি ভালোবাসার মালা সাজিয়ে নিয়ে এসেছি। আমি সব সময়ই অস্পষ্টতা ও ধূসরতাবিরোধী। অস্পষ্টতা, ধূসরতা, কপটতা স্বার্থপরতা সুযোগ সুবিধার পথে হাঁটাকে অপছন্দ করি। জীবন উৎসর্গ করেছিলাম মানুষ সমাজ রাষ্ট্র মানবতার সেবায়। নিজের জন্য ভারী ভারী পদ পদবি করায়ত্ব করতে নয। আর পদপদবীর জন্য নিজের চরিত্র বৈশিষ্ট্য কালিমা লিপ্ত করা আমার স্বভাববিরুদ্ধ।
অসাম্প্রদায়িক, ইহজাগতিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দ্বারা আমার মনন গঠিত ও বিকশিত এবং প্রতিনিয়ত এর চর্চা ও অনুশীলন করি। অমানুষ নই, ব্রতমান মানুষ। মনুষত্ব ও মানবতার চর্চা অনুশীলন করতে গিয়ে নিজের ভেতরে অনেকগুলো কুটরি নির্মাণ করেছি। মানুষ ও মনুষত্বের অনুশীলনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কুটরিতে প্রবেশ করি। সেই কুঠুরির একটা আমার ধর্ম কুঠুরি। সেখানে আমি সাচ্চা মুসলমান। ধর্মীয় জীবন একান্তই আমার জীবন। এই জীবনধারণে জনবাহবাহ বা নিন্দা কোনটাতেই আমি কুণ্ঠিত, বিব্রত ও ভীত সন্ত্রস্ত হই না। নিজের কাছে নিজেই জবাবদিহি করেই সন্তুষ্ট। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমার ধর্ম কুঠুরির ভাবজগৎ নিয়ে সমষ্টিতে আলোড়ন আন্দোলন দেখা দিয়েছে। সমষ্টি আমাকে ত্যাজ্য করেছে। যেভাবেই ভাবা যাক রাজনীতির সামষ্টিক কোনোক্রমেই ব্যষ্টির বা স্বতন্ত্র অবস্থান স্বীকার করে না। কারণ রাজনীতি মানব কল্যাণের একটি প্রকৃষ্ট উপায়, কোনো বিচ্ছিন্ন উপায় নয়। অন্যদিকে ব্যক্তি জীবন একান্তই ব্যক্তির। এখানে সমষ্টির প্রবেশ নিষিদ্ধ। ব্যক্তি এখানে সবকিছু। আমাকে ষড়যন্ত্রকারী, প্রতিশোধপরায়ন ধর্মদ্রোহী, গণদুশমন, শয়তানের রিপ্রেজেন্টেটিভ বিভিন্ন ঘৃণার পাত্র সাজাতে সবশেষে ধর্মকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমি স্পষ্ট করে দৃঢ়চিত্তে বলতে চাই, আমি ধর্মবিরোধী নই, আমি ধর্ম অনুরাগী, একনিষ্ঠ সাচ্চা মুসলমান। আমি বলতে সাহস পাই, ধর্মীয় অনুশাসন মানে যেসব করন্ত কাজ ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী গোষ্ঠী স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে তৎপর তাদের বিরুদ্ধে শান্তির ধর্ম ন্যায়ের ধর্ম সত্যের ধর্ম অন্ধকার থেকে আলোর দিশার ধর্ম ইসলামের সঠিক তাৎপর্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে অম্লান থাকবে আমার পথচলা।
আমার এই মনোভাবের প্রকাশ নিয়ে যতই ষড়যন্ত্র হোক, যত মিথ্যাচার হোক, যত আঘাত প্রতিঘাত আসুক, রাজনৈতিক সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আস্থা রেখে যেমন মোকাবেলা করেছি বর্তমানেও এর ব্যত্যয় ঘটবে না। আমি মনে করি হজ প্রতিপালন ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে অন্যতম ফরজ। এই ফরজ পালনেও আরও কতগুলো অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিপালন করে মাত্র একবারই করার কথা। যা নিজেও করেছি। ওয়াজিব সুন্নাত পরিহার করে অবশ্য পালনীয় ফরজ তরক করে যারা এই ফরজটি পালনে প্রতিবছর ব্যস্ত তাদের মানসিকতা আর আমার বিবেচনা ভিন্ন। হজ যে একটি বিরাট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তা কিন্তু মানতে না চাইলে মিথ্যা হয়ে যায় না। রোজার মাসটি আমার প্রাত্যহিক জীবনের অবশ্য পালনীয় মাস।আমি এই ধর্মীয় আচারটি পালন করি।
মহানবী আল্লাহর প্রেরিত প্রতিনিধি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। শূন্য থেকে একক প্রচেষ্টায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনে দক্ষ ও সফল রাষ্ট্রনায়ক। আমার চলার পথের আলোকবর্তিকা। আদর ভালোবাসা শ্রদ্ধা ও সম্মানে নিজের বুকে আগলে আব্দুল্লাহপুত্র মোহাম্মদ বলে আদর প্রকাশে কুণ্ঠিত ভীত বা শংকিত নই। এই দুর্লভ মানব জীবন সামনে মহানবীর আদর্শিক জীবন চলার নির্দেশনা থাকার পরও কি সুন্দরের আরাধনা মনে জাগবে না?
যতবার বলতে বলা হবে ততবার বলবো, তবলিগ প্রচারকারীরা যদি ধর্মপ্রচারের সঙ্গে সমাজ রাষ্ট্র চেতনা বৃত্তির দিকে মনোযোগী হতেন তাহলে তবলিগের যে প্রভাব আমাদের সমাজ জীবনে প্রতিফলিত তা আরও ফলবতী হতো, কার্যকর ভূমিকা রাখতো। নবী (সা.) কখনও জীবনকে অস্বীকার করে ধর্ম পালন করতে বলেননি। জীবনের জন্য ধর্ম অপরিহার্য। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে বিদায় হজের ভাষণে নিষেধ করে গেছেন। যারা অসাম্প্রদায়িক ও ইহজাগতিকতার কথা প্রচার করেও ধর্মানুগ নীতি নিয়ে শোরগোল তোলেন তাদের বিষয় নীরব থাকাই সমীচীন মনে করি।
তিনি বলেন, এমন বহিষ্কারের খড়গ এবারই প্রথম নয়। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও চারবার বহিষ্কৃত হয়েছি। বাঙালির আত্মপচিয়ের সরব ঘোষণার কারণেই। দল থেকে দুইবার বহিষ্কার হয়েছি দলীয় কর্মকাণ্ড দুর্বল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি বলে। এবারও কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ইহজাগতিক মনোভাব প্রকাশ করার কারণেই আমি দল থেকে বহিষ্কার, মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ, প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ হরণ করা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ কতখানি যৌক্তিক সে বিষয়ে বলতে চাই নিকট অতীতে মো. হানিফ যখন আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র থেকে ধর্ম নিরপেক্ষ সাম্প্রদায়িক নীতি আদর্শ বাদ দিতে ওকালতি করেন তখন তার এই তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। তখন ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ উঠেনি। কারণ দল তখন ক্ষমতায় ছিল না, দলের অবস্থা এমন রমরমা ছিল না।
নির্বাচন কমিশনকে তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল করার জন্য জাতীয় সংসদের স্পিকারের দেওয়া চিঠির বিষয়ে প্রশ্ন রেখে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমার যত আপত্তি সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ৪ দফা উল্লেখ করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে স্পিকারের চিঠির সম্পর্কে। ৬৬ অনুচ্ছেদের ৪ দফার বর্ণিত নির্দেশনা হলো, কোন ব্যক্তির প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা এবং থাকার বিষয়ে এক্ষেত্রে ৬৬ অনুচ্ছেদের দুই দফা কারণ সংসদের ৭০ অনুচ্ছেদের নির্দেশনার ব্যাপারটি স্পষ্ট। এ স্পষ্ট বিষয়টি আপনার বরাতে ধূসর হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, আমি বিবেচনা করি এ টিঠিতে কারণে সংসদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং সংবিধানের অপব্যাখ্যা হয়েছে বলে আমি মনে করি। বিনা শুনানিতে কোনো সংসদের আসন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেয়া যথাযথ কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। আপনি আমাকে সময় দিয়েছেন। বিদায় বেলা শুধু এ কথা বলতে চাই।
আমি মানুষের জন্য রাজনীতি করেছি, মানুষকে ভালোবেসেছি, বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে মানবকল্যাণে শপথ নিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর কন্যার নেতৃত্বে আমি অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছি। আজকে আমার সমাপ্তির দিন। এ দিনে আমার কারও বিরুদ্ধে কোনো ধরনের বিদ্বেষ, অভিমান এবং অভিযোগ আনছি না। দেশবাসী যদি আমার আচরণে কোনো দুঃখ পেয়ে থাকেন আমি নতমস্তকে তাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
আমি মানুষের ভালোবাসাকে আমার সৃষ্ট মূলধন মনে করি। সেই ওয়াদা করে সর্বশেষে আমি বলছি। উপরন্তু অনুনিত হয়েছি আমার নেতার অভিপ্রায় আমি আর সংসদ সদস্য না থাকি। কর্মী হিসাবে নেতার একান্ত অনুগত ছিলাম। বহিষ্কৃত হওয়ার পর ব্যত্যয় কিংবা ব্যতিক্রম সমুচিত মনে করি না। ইতিপূর্বে আমার প্রতিবাদ ছিল প্রতিকার পাওয়ার। এখন দ্বিধাহীন কন্ঠে, ঘৃণা বিদ্বেষ উগ্রে না দিয়ে, কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না করে দৃঢ় চিন্তে বাংলাদেশ সংসদের আসন ১৩৩ টাঙ্গাইল-৪ আসনের সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করছি। একই সঙ্গে মাননীয় স্পিকার আপনার বরাবর পদত্যাগ পত্রটি প্রেরণ করছি। আপনি অনুমতি দিলে আমি পড়েও শোনাতে পারি। তার বোধহয় প্রয়োজন নেই।
এ সময় স্পিকার বলেন, প্রয়োজন নেই।
মন্তব্য চালু নেই