সুন্দরবনকে সরকারই ঠেলে দিল ঝুঁকিতে

বারবার দুর্ঘটনার পরও সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ট্যাংকারে জ্বালানি তেল পরিবহনের অনুমতি দিয়েছে সরকার। এমনিতেই বন কেটে উজার করা এবং অবৈধ শিকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় এ বনের অলঙ্কার রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে ১০৬টিতে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদও হুমকির মুখে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন এবং বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবন রক্ষায় উদ্যোগ না নিয়ে সরকার আরো ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) মানদণ্ড অনুসারে তেলবাহী ট্যাংকার হতে হয় দ্বিস্তর ও দুই কাঠামোবিশিষ্ট (ডাবল বটম ও ডাবল হাল)। বাংলাদেশের তেলবাহী জাহাজের এক তৃতীয়াংশই এক স্তর কাঠামো বিশিষ্টি। সূত্র জানিয়েছে, সুন্দরবন এলাকায় যেসব জাহাজ ডুবছে তার বেশিরভাগই এক স্তরবিশিষ্ট। এসবের তলা ফেটে যায়।

সর্বশেষ গত ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে এক প্রকোষ্ঠের একটি তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে সাড়ে তিন লাখ লিটার তেল ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সরকার ওই পথ দিয়ে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে। পরে সীমিত আকারে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। তবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) তেল কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনাকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এক প্রকোষ্ঠের জাহাজে করে তেল পরিবহন করতে নিষেধ করে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ নিষেধাজ্ঞার পর এক প্রকোষ্ঠের জাহাজে তেল পরিবহনের অনুমতি দিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে বারবার চাপ দেয়া হয়। জাহাজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকার উচ্চ পর্যায়ের একটি মহল যোগসাজশে এ চাপ সৃষ্টি করছে বলে জানা গেছে। তবে সুন্দরবনের স্বার্থে নেয়া সিদ্ধান্তটি জ্বালানি মন্ত্রণালয় দ্রুত বদলাতে চায়নি।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দাবি দেখে মনে হচ্ছে সুন্দরবনের চেয়ে গুটি কয়েক নৌযান মালিকের স্বার্থই তাদের কাছে বড়!

কিন্তু গত ১৬ জুলাই বিপিসি থেকে নতুন এক নির্দেশনায় বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম-বারশাল-হুলার হাট-বগিসন্ন্যাসী-জয়মনিরঘোল-মংলা-ধৌলতপুর রুটে ডাবল হাল ডাবল বটম ট্যাংকারের মাধ্যমে তেল পরিবহনের যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েঠিল, তার কার্যকারিতা স্থগিত করা হলো। জুলাইয়ের ২০ তারিখ থেকে নতুন নির্দেশনা কার্যকর হবে।’ অর্থাৎ এখন থেকে এক স্তর কাঠামোর ট্যাংকারে তেল পরিবহন করা যাবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি বলেতে পারব না। আমি আজকেই (২৭ জুলাই) চিঠি দেখেছি। বিপিসিই ভালো বলতে পারবে। তারাই নিষেধ করেছে। আবার তারাই তুলে নিয়েছে।’

এ বিষয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান বদরুদ্দোজা চৌধুরী স্বীকার করে বলেন, ‘নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়থেকে বারবার অনুরোধ করায় এ অনুমতি দেয়া হয়েছে।’ সুন্দরবনের পরিবেশের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা (নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়) এ বিষয়ে বলতে পারবে ।

সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ফখরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলটির সংস্কার কাজ শেষ না হওয়ায় ও সমুদ্র উত্তাল থাকায় অন্য পথে তেল পরিবহনে সমস্যা হচ্ছে। তাই সীমীত আকারে শুধু দিনের বেলার জন্য এক স্তরের কার্গোতে তেল পরিবহনের অনুমতি দেয়া হয়েছে।’ এতে সুন্দরবনের ক্ষতির আশঙ্কা নেই বলে তার দাবি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশে আন্দোলন (বাপা) সেক্রেটারি ডা. আব্দুল মতিন বলেন, ‘সরকার বা এর ভেতরের কোনো মহল চায় না সুন্দরবন থাকুক। তাদের সব বিষয়ে উৎকণ্ঠিত দেখা যায়, কিন্তু সুন্দরবনের বিষয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। তাই জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে।’ তিনি সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।

গত ৯ ডিসেম্বর পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে ফার্নেস অয়েল নিয়ে ‘সাউদার্ন স্টার সেভেন’ নামের একটি জাহাজ ডুবে যায়। এই জাহাজটি আগে বালু পরিবহন করতো। বিষয়টি নিয়ে সে সময় দেশের ভেতরে বাইরে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তেলবাহী কার্গো থেকে সুন্দরবন এলাকায় সাড়ে তিন লাখ তেল ছড়িয়ে পড়ে। এ থেকে থেকে এক লাখ লিটার তেল অপসারণ করা হয়। বাকি আড়াই লাখ লিটার তেল থেকে যায়, যা বনের প্রতিবেশে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি করতে পারে বলে জাতিসংঘ, বন বিভাগ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

সেসময় সরকার সুন্দরবনের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কামনা করে। জাতিসংঘ সুন্দরবনের ক্ষতি পর্যবেক্ষণ এবং কাটিয়ে ওঠার জন্য এগিয়ে আসে। এরপর সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধও ছিল। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট হিসেবে মংলা ঘষিয়াখালি চ্যানেলের সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে আবারও পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের অনুমোদন দেয় বিআইডব্লিটিএ।

এরপর গত ৪ মে সুন্দরবনে আবারও জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে। শরণখোলা রেঞ্জের মরা ভোলা এলাকার ভোলা নদীর চরে আটকে ৫০০ টন সার নিয়ে এমভি জাবালে নূর নামের জাহাজটি ডুবে যায়। এছাড়া এই রুটে গত বছর ডুবে যাওয়া চারটি জাহাজের মধ্যে এমভি শাহিদূত, এমভি হাজেরা-২, এমভি নয়ন শ্রি-৩ উদ্ধার করা সম্ভবই হয়নি ।

বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, এবং জাতিসংঘের রামসার কনভেনশনের তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিটিএ) ২০১১ সালের নভেম্বরে বিআইডব্লিটিএ সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে জাহাজ চলাচলের অনুমোদন দেয়। শুরুতে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫টি জাহাজ চললেও এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০টিতে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে সব মিলিয়ে ২১৯টি ট্যাংকার রয়েছে যা অভ্যন্তরীণ রুটে তেল পরিবহন করে। এরমধ্যে ৫১টি দ্বিস্তর ও দুই কাঠামোবিশিষ্ট, বাকি সবগুলোই এক স্তরবিশিষ্ট।

২০১০ সালের পর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করায় জ্বালানি তেলের চাহিদা বেড়ে যায়। এতে করে অনেকেই বালুবাহী এক প্রকোষ্ঠের জাহাজকে জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকরে পরিণত করে।

এসময় রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ফার্নেস অয়েল সরবরাহের জন্য ৭৮টি জাহাজকে অনুমতি দেয়া হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩৩টি উপকূল এলাকায় তেল পরিবহন করতে সক্ষম। বাকি ৪৫টি দেশের অভ্যন্তরে তেল পরিবহনে অনুমতিপ্রাপ্ত। এই ৭৮টি জাহাজ নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ট্যাংকার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপিটিওএ)।

অন্যদিকে ১৯৭৩ সাল থেকে তেল পরিবহন করে আসছে বাংলাদেশ তেলবাহী জাহাজ মালিক সমিতি (বিওটিওএ)। তাদের মোট ১০৯টি জাহাজে সরকারের অনুমোদন রয়েছে। এরমধ্যে ৯১টি উপকূল এলাকায় তেল বহনের কাজে নিয়োজিত। ১৮টি অগভীর নৌপথের তের পরিবহনের কাজ করার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত। বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই