৭ ডিসেম্বর : সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস

স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জন। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃংখল ছিন্ন করে অন্ধকারের অচলায়তন ভেঙ্গে মুক্তি সংগ্রামে আত্মদানের কঠিন দীপ্ত প্রত্যয়ে বাংলা’র দামাল ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সর্বাত্বক লড়াইয়ে। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা জেলা পরাধীনতার শৃংখল মুক্ত করেছিল। পাকিস্তানী পতাকায় ছাত্র জনতার অগ্নি সংযোগ এবং অস্ত্রলুট ও ব্যাংক অপারেশন করে সংগৃহিত অর্থ নিয়ে ৭১ এর মার্চে সাতক্ষীরার সন্তানরা মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল তারই সফল সমাপ্তি ঘটে ৭ ই ডিসেম্বর। ঐদিন বীরের বেশে এই মাটির সন্তানরা বাংলাদেশের অর্জিত পতাকা কাঁধে নিয়ে সাতক্ষীরায় এসেছিল। চুমু খেয়েছিল মাটিতে আজ সেই ৭ই ডিসেম্বর। বিজয়ের গৌরবে ৭১ এর এই দিনে যুদ্ধাহত মানুষ আনন্দের উদ্দেলিত হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেদিনের সাহসী সন্তানরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। পাক হানাদার ও তাদের দোসররা মা-বোনের ইজ্জত হরন করেছিল। ধ্বংস করতে চেয়েছিল বাঙ্গালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে। শত্রুর বুলেটের এত সব আঘাত সহ্য করেও সাতক্ষীরার সন্তানরা অন্তত ৫০টি যুদ্ধের মোকাবেলা করেছিল। আক্রমন পাল্টা আক্রমন শত্রুর ঘাটি দখল, শত্রু বিতাড়ন ইত্যাদির মধ্য ৭ ই ডিসেম্বরের বিজয় অর্জনের সেই দিনটি ছিল আনন্দশ্র মিশানো এক ঐতিহাসিক দিন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোন সেক্টর গড়ে উঠেনি তখনও। পরবর্তীতে গড়ে ওঠা ৯ম আর ৮ম সেক্টরের সাতক্ষীরার ভোমরা ছিল প্রথম ক্যাম্প। এখানেই সূচনা লগ্ন থেকে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল তৎকালীণ ই.পি আরদের সহযোগিতায়। আর ওখানেই ২৯ এপ্রিল পাক বাহিনীর সাথে তরুন নবীন মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দীর্ঘ ১৭ ঘন্টা উভয় পক্ষের গুলি বিনিময়ে পাক বাহিনী হারিয়েছিল তাদের কয়েকজন সেনা কে। আর দুই দফায় যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল তিন বীর যোদ্ধা। সাতক্ষীরা মুক্তিযোদ্ধাদের দেশাত্বাবোধ আর বীরোচিত যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসাবে ৭১ এর নভেম্বরে শ্যামনগর কালিগঞ্জ শত্রু মুক্ত হয়। অন্যদিকে ৭ই ডিসেম্বর মুহিদ খান দুলুর নেতৃত্বে একটি শাক্তিশালী যোদ্ধাদল ধুলিহর ইউনিয়নের বেজেরডাঙ্গায় তখনও গেরিলা অপারেশনের পরিকল্পনা করছে। এরই মধ্যে খবর এলো পাক বাহিনী সাতক্ষীরা ছাড়তে শুরু করেছে। ক্ষিপ্রবেগে এই দলটি চলে এলেন সাতক্ষীরা শহরে। ক্যাম্প করলেন পি এন হাইস্কুলে ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে আর একটি দল ঢুকে পড়ে সাতক্ষীরা শহরে। তারা থানা, ডাক বাংলোর পিটি আইতে ঘাটি গাড়ে। এদিকে বীর যোদ্ধা আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে আরও একটি দল অবস্থান নেন, সাতক্ষীরা শহরে। এই ত্রিমুখী আক্রমনের পালা আসতে না আসতেই খবর এলোপাক বাহিনী ও দোশররা পিছু হটছে। বিজয় গৌরবে কাঁধে পিঠে অস্ত্রের বোঝা আর ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে যোদ্ধারা সদর্পে পুনঃ দখল করলেন তাদের প্রিয় মাতৃভূমি। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে অনেক কে হতে হয় শহীদ। সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৭জুন প্রতুষে। দেবহাটা থানার টাউন-শ্রীপুর। যে মহাপরিকল্পনা করে পাক বাহিনীর ব্যুহভেদ করার অঙ্গীকার করা হয়েছিল তা ফাঁস হয়ে যায়। এ সত্বেও মুক্তিকামী দামাল ছেলেরা সেদিন তাদের অস্ত্র দিয়ে শত্রু সেন্যদের জবাব পাল্টা জবাব দিয়েছিল। ৯ম সেক্টরের সদর দপ্তর টাকী থেকে তিনটি পৃথক গ্রুপ তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকে পড়ে মাতৃভুমির মাটিতে। টাকীর ঠিক বিপরীতে টাউন শ্রীপুর এলাকায় অবস্থান ও টহলরত পাক সেনাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে কাপ্টেন শাহাজান মাস্টারের নেতৃত্বে একটি গেরিলা গ্রুপ অবস্থান নেয় ৬ জুন রাতে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় পরদিন সুযোগ বুঝেই ওদের উপর আক্রমন চালানো হবে। কিন্তু উপর্যূপরি রাত জাগা সেনারা কেউ তখনও ঘুমিয়ে কেউ বা নাশকতা করছে, এমনই এক পর্যায়ে খান সেনাদের তৎপরতা ধরা পড়ে। এ সময় একে অন্যকে সতর্ক করা চলতে থাকে। মুহুর্তেই আক্রমাত্মক গুলি ছুটে যায় পাক বাহিনীর সদস্যদের দিকে। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। মুহু মুহু গুলির রেঞ্জে পড়ে বেশ কয়েকজন, পাক সেনা লুটিয়ে পড়ে। অপরদিকে শত্রুদের গুলিতে শহীদ হন কাজাল, খোকন, নারায়ন ও এক ইঞ্জিনিয়ার ছাত্র সহ ৭ মুক্তিযোদ্ধা। ওদের রক্তে ভেসে যায় শুষ্ক মাটি। এ যুদ্ধে ব্রাশ ফায়ারে বেশ কয়েকটি গুলি বিধে যায় এরশাদ খান হাবলুর দেহে। ওরা শহীদ হয়েছিল এবং তিনি নিজে গুলি বিদ্ধ হয়েছিলেন বটে। কিন্তু এই সম্মুখ যুদ্ধে কামরুল ইসলাম খানের ভুমিকা ছিল খুবই বীরোচিত। পাক বাহিনীর অন্যতম খুটি মহকুমা হাকিম খালেদ মাহমুদকে গ্রেফতার, তার অফিসের পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে অগ্নি সংযোগ এবং বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন। ট্রেজারী থেকে অস্ত্র আর ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে অর্থ সংগ্রহসহ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্ন থেকে শেষ দিনটি পর্যন্ত কামরুল ইসলাম খান রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। এই সেক্টরে যুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণকারী মুক্তি যোদ্ধাদের মধ্যে রয়েছেন আইয়ুব আলি, আলাউদ্দিন, সালাম, এরশাদ হোসেন হাবলু, কামরুজ্জামান, এনামুল, গণি, রশিদ, আজিবর, খসরু , মোস্তাফিজ, হাসনে জাহিদ জজ, মুজিবর। এছাড়া স,ম বাবুর আলী সহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা তারা আজ স্ব স্ব অবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে। কিন্তু শাহাদত বরণকারী সেই নব সোনার সন্তানরা আজ অনেকেই লোকান্তরে দেশ মাতৃকার মুক্তি অর্জন দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার দুর্দান্ত প্রভাবশালী শার্দল কাপ্টেন শাহাজান মাস্টার ও আজ লোকান্তরিত মনে পড়ে তাদের ই কথা বারবার। কবর স্থান, স্মৃতি স্তম্ভ গুলি আজ ও অরক্ষিত কিংবা অবহেলার শিকার। আর তাই আনন্দ বেদনা যোগায় সেই সব যুদ্ধ ফেরত মুক্তি যোদ্ধাদের। যখনই আসে ডিসেম্বর ৭ ডিসেম্বর, সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস। এদিকে আজ ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস উপলক্ষে সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ , সাতক্ষীরা জেলা কমান্ড ইউনিটের পক্ষ থেকে দিন ব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি ব্যবসার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের সূচনা। সকাল সাড়ে ৯টায় আনুষ্ঠানিক ভাবে জাতীয় পতাকা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পতাকা উত্তোলন। সকাল ১০টায় সাতক্ষীরা মুক্ত দিবসের বর্নাঢ্য র‌্যালী। সকাল ১১টায় সাতক্ষীরা মুক্ত দিবসের উপর আলোচনা সভা। বাদ জোহর জাতির শান্তি,অগ্রগতি এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত। দুপুর ২টায় মধ্যাহ্ন ভোজ এবং বিকাল ৩টা থেকে সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই