৪৬তম ফাঁসির অপেক্ষায় জল্লাদ শাহজাহান
মো. শাহজাহান ভূঁইয়া। জেলখানায় তাকে ‘জল্লাদ শাহজাহান’ নামেই চেনেন সবাই। জন্ম ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ। বাবার নাম হাসান আলী ভূঁইয়া। মায়ের নাম সবমেহের। নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
তিন বোন এক ভাই তারা। শাহজাহান লেখাপড়া করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম খাস হাওলা পাইমারি স্কুল। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নাম পারলিয়া উচ্চবিদ্যালয়। ১৯৭৪ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন শাহজাহান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অবিবাহিত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করেছেন তিনি। সামনে যেকোনো সময় আরেক সাজাপ্রাপ্ত আসামি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি তিনিই কার্যকর করবেন। আর এ জন্যই তাকে কয়েক দিন আগে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়েছে।
আগেই জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা ছিল, জল্লাদ শাহজাহানের সঙ্গে রাইজিংবিডিকে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবে। শুক্রবার সকাল ৯টায় সাক্ষাৎও দেওয়ার কথা। পরে পিছিয়ে বেলা ৩টায় সাক্ষাৎ হয় তার সঙ্গে।
প্রায় ২০ মিনিট কথা হয় শাহজাহানের সঙ্গে। এই সময়ে জানালেন তার জীবনের অনেক অজানা করুণ কাহিনি। তিনি বলেন, ৩৬ বছর ধরে কারাবন্দি আছেন। এ পর্যন্ত ৪৫ জনকে ফাঁসি দিয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফাঁসিগুলো হলো : ১৯৯৭ সালে বহুল আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসান, ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা জেলা কারাগারে এরশাদ শিকদারের ফাঁসি, ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর রংপুর জেলা কারাগারে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আসামি এএসআই মইনুল হক ও আবদুস সাত্তারকে ফাঁসি। ২০০৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আরেক আসামি পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণ। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ কাশিমপুর ও ময়মনসিংহে জঙ্গিনেতা সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানী, আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও ইফতেখার মামুন। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি বজলুল হুদা, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও ল্যান্সার মহিউদ্দিন আহমেদ।
ছোটবেলা থেকেই জল্লাদ শাহজাহান সেনাবাহিনীর প্রতি আকৃষ্ট হন। এ জন্য তিনি এইচএসসি পাসের পর সেনাবাহিনীতে চাকরি নেন। তিন বছর সেনাবাহিনীতে চাকরি করার পর সেনাদের নিয়মকানুন ভালো না লাগায় তিনি বাড়ি ফিরে যান। একটাই কারণ- যারা বড় কর্মকর্তা তারা শাহজাহানের চেয়ে পড়াশোনায় অনেক কম। একটানা ১১ মাস চাকরিস্থলে উপস্থিত না হওয়ায় তার চাকরিটা চলে যায়।
১৯৭৪ সালে এইচএসসি পড়ার সময় টগবগে তরুণ শাহজাহান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও ১৯৭৭ সালের শেষের দিকে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তার পারফরম্যান্স দেখে তাকে কেন্দ্রে ডেকে পাঠানো হয়। সেখান থেকে নরসিংদী জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব দিতে চাইলে তিনি রাজি হন। পরের বছর তিনি নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
ব্যক্তি হিসেবে শাহজাহান ভূঁইয়া খুবই ভালো প্রকৃতির ছিলেন। পারতপক্ষে কারোর উপকার ছাড়া ক্ষতি করার চেষ্টা করতেন না। তিনি প্রচণ্ড বন্ধুপাগল ছিলেন। একবার তার গ্রামে নারীঘটিত একটি ঘটনা ঘটে। তাতে দুই বন্ধুসহ তার নামে অভিযোগ ওঠে। তাকে নিয়ে গ্রামে বিচার-সালিশ বসে। সেই বিচারে তাকে অপরাধী প্রমাণ করে সাজা দেওয়া হয়। এর পর থেকেই তার ক্ষিপ্রতা শুরু। তিনি অপমান সহ্য করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন- অপরাধজগতে প্রবেশ করে এই অপমানের চরম প্রতিশোধ নেবেন। যে সিদ্ধান্ত সেই কাজ। তারপরের ইতিহাস অনেক লম্বা।
নারীঘটিত ওই ঘটনার পর শাহজাহান ভূঁইয়া বাংলাদেশের একজন বহুল পরিচিত সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। তা ছাড়া, কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করার পর থেকে যেকোনো অপারেশনে তার চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন করেছিলেন ১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায়। আর তা ছিল শাহজাহান ভূঁইয়ার জীবনের শেষ অপারেশন।
মাদারীপুরে অপারেশন শেষ করে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাবে। এ জন্য মানিকগঞ্জে পুলিশ চেকপোস্ট বসালে শাহজাহান তা জেনে যান। এর পরও তিনি ঢাকায় ঢোকার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। রাতভর মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হলেও পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। শাহজাহান ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন, পথে পুলিশ তাকে আটক করে। তার গতিময় জীবনের সমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় বন্দিজীবন।
১৯৭৯ সালে আটক হওয়ার আগে ও পরে তার নামে সর্বমোট ৩৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি অস্ত্র মামলা, একটি ডাকাতি মামলা এবং ৩৪টি হত্যা মামলা। ১৯৮৮ সালে তার যাবজ্জীবন সাজা হয়। এরপর ১৯৯৫ সালে তার ১৪৩ বছরের সাজা হয়। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১০০ বছর মাপ হয়ে ৪৩ বছরের জেল হয়। জেল থেকে বের হওয়ার তারিখ শাহজাহানের জেল কার্ডের ওপর লেখা আছে, ‘ডেট অব রিলিজ ২০৩৫’।
যখন তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন তখন তার বয়স হবে ৮৫ বছর। কী লাভ হবে তখন কারাগার থেকে বের হয়ে? এ জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নেন জল্লাদ খাতায় নাম লেখাতে। তিনি জানতেন একটা ফাঁসি দিলে দুই মাস চার দিনের সাজা কমে। এভাবে যদি সাজা কিছুটা কমে! জেলারের অনুমতি নিয়ে ১৯৮৯ সালে প্রথম তিনি সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ে নুরুল ইসলামকে ফাঁসি দেন। ওটাই ছিল শাহজাহানের জীবনে কারাগারে কাউকে প্রথম ফাঁসি দেওয়া। তার যোগ্যতা দেখে আট বছর পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের আসন প্রদান করে। আর প্রধান জল্লাদ হওয়ার পর ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানকে প্রথম ফাঁসি দেন তিনি।
কারা সূত্রে জানা যায়, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের রায় কার্যকর করা হয় যেসব দেশে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯৭১ সালের পর এখন পর্যন্ত সাড়ে চার শতাধিক মানুষকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এক হাজারের বেশি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি কারাগারে রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন শতাধিক। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ছাড়াও দেশের আরো ১৪টি কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ রয়েছে।
ফাঁসি দেওয়ার জন্য প্রাক্তন দুই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদের আমলে ম্যানিলা থেকে ১০ হাজার ফাঁসির রশি আমদানি করা হয়। ওই রশি দিয়েই এ দেশের ফাঁসির কার্যক্রম চলছে।
সবশেষ জল্লাদ শাহজাহান বলেন, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তিনি তাদের ফাঁসি দিয়েছেন। তিনি আশা করেছিলেন ‘শেখের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী, সে তার দিকে একটু সুনজর দেবেন। কিন্তু কে রাখে কার খবর? তার কথা কেউ বিবেচনা করেনি।’
তিনি বলেন, নেলসন ম্যান্ডেলা বেশি সময় জেলখানায় কাটিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলেন। আর এখন তিনি (শাহজাহান) জীবনের ৩৬টি বছর কারাগারে কাটিয়ে দিলেন। বাইরে মানুষ হত্যা করলে জেল হয়, ফাঁসি হয়। আর এখানে এত মানুষ হত্যা করছি, কিন্তু কিছুই হয় না।
এ জন্য শাহজাহান মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। কারাগারে তার ভালো লাগে না। এত কিছুর পরও কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করতে তিনি প্রস্তুত আছেন। আর এ জন্য তিনি প্রয়োজনীয় মহড়াও সেরে নিয়েছেন।
মন্তব্য চালু নেই