১৮ বছরের আগে বিয়ে কেন বিপদজনক?
মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল রোজিনা পারভিনের। দু’বছর না যেতেই সে এখন কন্যা সন্তানের মা। আর স্বামীও তাকে ছেড়ে গেছেন সন্তান জন্মের আগে।
মেয়েকে নিয়ে রোজিনা ঢাকায় বস্তিবাসী। বাবা-মার কুঁড়েঘরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বলছিলেন, হতদরিদ্র পরিবারে শারীরিক মানসিক এক যন্ত্রণার জীবন এখন তার।
“মেয়ে হওয়ার আগে আমার ওজন ছিল ৪৫ কেজি। বাচ্চা হওয়ার পর এহন ৩২কেজি। আমার বাচ্চা হইছে সিজারে। অনেক ধরনের সমস্যা। মাজা কোমরে ব্যাথা, শরীল দুর্বলতা সবই এখন দেখা যায়।”
রোজিনা বলছিলেন, তার অগোচরেই তিনি গর্ভবতী হয়েছিলেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী রোজিনার অল্প বয়সে বিয়ে এবং গর্ভধারণের ফলেই এসব সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
চিকিৎসকরা বলেন, আঠারোর আগে শারিরীক মানসিক কোন দিক দিয়েই একটি মেয়ে বিয়ে এবং গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হয় না। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. ফারহানা দেওয়ান বলেন সন্তানধারণের জন্য শরীরের প্রস্তুতি প্রয়োজন।
“পিউবার্টি বলি আমরা যে বয়সে প্রথম পিরিয়ড হবে -তার পরে আস্তে আস্তে তার বডিটা ডেভলপ করবে। এই ডেভলপমেন্টের জন্য একটা সময় দিতে হয়। পনের থেকে আঠার বছর পর্যন্ত এই শরীর গঠন চলতে থাকে। আঠারো বছরের আগে যদি মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয় তখন তার প্রপার গ্রোথ হয় না। এক্ষেত্রে গর্ভধারণ করলে প্রিম্যাচিওর ডেলিভারির শঙ্কা থাকে। যেটি শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি করে।”
দেখা যাচ্ছে বাল্য বিবাহ মেয়েদের স্বাস্থ্যে সমস্যার পাশাপাশি শিশু মৃত্যুরও অন্যতম কারণ।
ইউনিসেফের তথ্য বলছে কুড়ি বছরের আগে মেয়েরা সন্তান জন্ম না দিলে বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৩ হাজার শিশুর জীবন রক্ষা পাবে।
ইউনিসেফের সবশেষ হিসেবে বাংলাদেশে ৫২.৩% মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। আর ১৫ বছরের আগে বিয়ে হয় ১৮.১ শতাংশের। ১৮ বছরের আগে বিয়ের দেওয়ার ক্ষেত্রে পৃথিবীর শীর্ষে অবস্থানকারী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৫ম এবং ১৫ বছরের আগের তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে ৬ষ্ঠ অবস্থানে।
রোজিনার মতো মেয়েদের যেন আঠারো বছরের আগে বিয়ে না হয়, সেজন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ১৯২৯ সালের আইন সংশোধনী এনেছে।
সরকারের মন্ত্রিসভা এর নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে তবে সেখানে একটি ধারায় ”নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে” ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে।
মানবাধিকার এবং নারী সংগঠন, চিকিৎসক এবং নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা দেশি বিদেশি এনজিওগুলো এর ঘোর বিরোধী।
জাতীয় মহিলা পরিষদের সভানেত্রী আয়শা খানম বলেন, “আজকে যারা কন্যা তাদের স্বাস্থ্য, তাদের ক্ষমতায়ন, তাদের মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন -এগুলো শারীরিক, মানসিক এবং পারিবারিকভাবে পালনের যোগ্যতা অর্জনের জন্য জাতিসংঘ একটি ন্যুনতম বয়স ঠিক করে দিয়েছে- যেটা আঠারো। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, বিশ্ব সম্মেলন, জাতিসংঘের ঘোষণা তার সঙ্গে সরকারের আইনের এ ধারা কন্ট্রাডিক্টরি”।
আয়শা খানমের আশঙ্কা বিশেষ ধারার সুযোগ নিয়ে আইনের অপব্যবহার হবে। তিনি বলেন, আইনে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ বলতে যেগুলো আলোচনায় এসেছে সেটিও উদ্বেগের।
“তবে একটা ধারা হলো যদি প্রেগনেন্ট হয়ে যায় তাহলে বিচারালয় এবং অভিভাবকের পরামর্শ ও সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিয়ে দেওয়া যাবে। আমার মনে হয় এতে করে ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়া হবে। যেটা বাংলাদেশের জন্য আরেকটা ভয়াবহ চিত্র হবে এবং ধর্ষণের শিকার সন্তান তাদেরকে বৈধতা দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করবে। এছাড়া এতে করে কম বয়সীদের মধ্যে গর্ভধারণের প্রবণতাও বাড়বে,” বলেন আয়েশা খানম।
আইনের এ বিরোধিতা নিয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম বলেন, আইন সংশোধনের মাধ্যমে বাল্য বিবাহ বন্ধে আরো জোরদার পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার। এতে আইন আরো শক্তিশালী হচ্ছে। শাস্তিও বাড়ানো হয়েছে। যে বিয়ে পড়াবে তাকেও শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।
আইনে বিশেষ ধারা রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন সব আইনেই একটা বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হয় যেটা আইনের বৈশিষ্ট্য।
“আইনে বলা হয়েছে কন্যা শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতে যেতে হবে। সেখানে আদালত এবং বাবা মা উভয়ের সম্মতি লাগবে। এটা বিধিতে বলা থাকবে যে কখন কোন্ প্রেক্ষাপটে আদালত থেকে বিয়ের অনুমতি দেয়া হবে। এটা যেরকমভাবে বলা হচ্ছে যে -একেবারে অবাধ সুযোগ দেয়া হচ্ছে- তা নয়।”
নাছিমা বেগম বলেন, সংশোধনী নিয়ে অনেকেই ভুল ব্যাখ্যা করছেন।
আইনটি পাশ হলে বাস্তবায়নের জন্য বিধিমালা প্রণয়ন করা হবে এবং সেখানে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। বিধিমালা করার সময় সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলেও জানান সচিব।
মন্তব্য চালু নেই