বিশ্ব বাঘ দিবস আজ
১১ বছরে সুন্দরবনের বাঘ কমে এক-চতুর্থাংশ
আজ ২৯ জুলাই, বিশ্ব বাঘ দিবস। ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে এই দিনটিকে বিশ্ব বাঘ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাঘ টিকে আছে এমন ১৩টি দেশে বাঘ দিবস পালন করা হয়। এই দিনটিতে বাঘ নিয়ে সচেতনতামূলক বিভিন্ন সভা-সেমিনার হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও বাঘের সংখ্যা কমছে দিন দিন। বিশেষ করে সুন্দরবনে গত ১১ বছর আগে যে বাঘ ছিল, তা এখন এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে।
সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই প্রকাশিত ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনার জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১০৯টিতে। অথচ ২০০৪ সালে বন বিভাগ প্রথমবারের মতো বাঘের পায়ের ছাপ গুনে সংখ্যা নির্ধারণ করেছিল ৪৪০টি। দুই বছর পর ২০০৬ সালে ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনা করে এর সংখ্যা নির্ধারণ করে ২০০টি।
রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবার্গ শহরে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে যেখানে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, সেখানে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমেই চলেছে। এ অবস্থার মধ্যে আজ সুন্দরবন সন্নিহিত জেলাগুলোসহ সরকারি ও বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন সভা, সমাবেশ, র্যালিসহ নানান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করছে।
ক্ষতিগ্রস্ত বাঘের আবাসস্থল
বাংলাদেশে বাঘের প্রকৃত আবাস বলতে বোঝায় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনকে। বর্তমানে এ বনের উজানে ফারাক্কা বাঁধের কারণে মিষ্টি পানির প্রবাহ বন্ধ হয়েছে। ফলে নদ-নদীর পানিতে লবণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সে জন্য বন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সুন্দরী, গোলপাতাসহ অনেক ধরনের গাছপালা। এ ছাড়া উষ্ণতা, মানুষের উপস্থিতি, লবণ জলের আধিক্য, বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ায় কারণে করুণ অবস্থা সুন্দরবনের পাহারাদার বাঘের।
তাপমাত্রার হেরফেরে মৌসুমি বায়ু নির্দিষ্ট সময়ে হচ্ছে না। সময়মতো বৃষ্টি হচ্ছে না। আবার কখনো কখনো অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে পরিমাণের চেয়ে ঢের বেশি। এর প্রভাবে সুন্দরবনের গাছ মরছে। এ ছাড়া গঙ্গা অববাহিকার যে মিষ্টি জল গড়াই ধরে সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়ত, তা আবশ্যিক সময়ে না পাওয়ায় এ বনের জলে লবণের মাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে গিয়ে বিপর্যয় ঘটাচ্ছে বনের পরিবেশের সব পর্যায়ে। এর প্রভাবে বৃক্ষ, তরুলতা, মাছ, জলজ অন্যান্য প্রাণী, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জীবনযাত্রায় অস্বাভাবিক অস্থিরতা এসেছে।
বিশেষজ্ঞদের মত
বাংলাদেশের বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে যে সংখ্যক বাঘই থাকুক, দ্রুত এর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। এর কারণ হিসেবে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে একদিকে বন ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ধ্বংস হওয়া এলাকায় নতুন বসতি গড়ে উঠছে। এতে বনের ওপর নিভর্রশীল মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। আর এ কারণে বাঘের স্বাভাবিক চলাচলের স্থান ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে।
আবার ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার পর হঠাৎ করে বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ার সংখ্যা বেড়ে গেছে। কারণ, সিডর ও আইলায় নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় জোয়ারের পানি বনের ভেতর প্রবেশ করে আর বের হতে পারছে না। এতে বনের মিষ্টিপানির পুকুরগুলো লোনাপানিতে ভরে যাওয়ায় বাঘ মিষ্টিপানির আশায় লোকালয়ে প্রবেশ করছে।
তা ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় এখন চোরা শিকারিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের বাঘ। ১৯৮০ থেকে বাঘের চামড়া সংগ্রহ শুরু হওয়ার পর বিদেশে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
বাঘ নিধন
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জসংলগ্ন গ্রামগুলোয় একাধিক সংঘবদ্ধ বাঘ শিকারি দল রয়েছে। এদের অবস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটার চরদুয়ানী, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, রামপাল, মোংলা, মোরেলগঞ্জ, পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালীগঞ্জ, খুলনা জেলার পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলায়। বাঘ শিকারিরা জেলে সেজে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে, ফাঁদ পেতে, বন্দুক দিয়ে গুলি করে বাঘ হত্যা করে।
শিকারিরা বাঘ হত্যার পর স্থানীয় পদ্ধতিতে বাঘের চামড়া সংরক্ষণ করে। পরে তা পাচারকারী চক্রের সাহায্যে বিদেশে পাচার হয়। স্থানীয়ভাবে একটি চামড়ার জন্য শিকারিরা দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা পেলেও বিদেশের চোরা বাজারে একটি চামড়া ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানা গেছে।
বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০০১ সালের ২০ নভেম্বর শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালী এলাকা থেকে একটি স্ত্রী বাঘ ও একই বছরের ১২ ডিসেম্বর চাঁদপাই সদর রেঞ্জ এলাকায় একটি পুরুষ বাঘ ও ২০০৫ সালের ২৬ অক্টোবর একই রেঞ্জের বলেশ্বর নদীর পাড়সংলগ্ন বন থেকে মোট তিনটি বাঘের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বয়সের কারণে যাদের মৃত্যু হয়েছিল।
২০০২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর চাঁদপাই রেঞ্জের জোংড়া টহল ফাঁড়ি এলাকায় একটি পুরুষ বাঘকে দুষ্কৃতকারীরা গুলি করে হত্যা করে। ২০০৩ সালের ২৮ মে চাঁদপাই রেঞ্জের নলবুনিয়া গ্রামে, ১৯ অক্টোবর শরণখোলা রেঞ্জের চালিতাবুনিয়া গ্রামে, ২১ ডিসেম্বর চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া গ্রামে ও ২০০৯ সালে ২ জুলাই শরণখোলা রেঞ্জের রাজাপুর গ্রামে লোকালয়ে ঢুকে পড়লে গণপিটুনিতে মারা যায় চারটি বাঘ।
এ ছাড়া ২০০৮ সালের ২৫ আগস্ট শরণখোলা রেঞ্জের কাঁঠালতলার বেলায়েত হোসেনের বাড়ি থেকে একটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়। ২০০৬ সালের ২ নভেম্বর শরণখোলা এলাকার নুরুজ্জামানের বাড়ি থেকে একটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়। ২০০৭ সালের ২ মে চাঁদপাই রেঞ্জের হাড়বাড়ীয়া টহল ফাঁড়ির পুকুরপাড় থেকে একটি মৃত বাঘ উদ্ধার করা হয় ও ১৬ নভেম্বর চাঁদপাই রেঞ্জের ঢাংমারী স্টেশনের ঘাঘরামারী ক্যাম্প এলাকা থেকে সিডরের আঘাতে মারা যাওয়া একটি বাঘকে উদ্ধার করা হয়।
বন কর্মকর্তার ভাষ্য
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম জানান, ২০১৫ সালের সর্বশেষ ক্যামেরা জরিপে দেখা যায়, বর্তমানে সুন্দরবনে ১০৯টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে। গত ১২ বছরে চোরা শিকারিসহ বিভিন্ন কারণে সুন্দরবনের ১৭টি বাঘ মারা গেছে। পরিবেশবিদদের হিসাবমতে এর সংখ্যা ৩০টি।
২০০১ থেকে ২০১২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৩০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ১৬টি পূর্ব সুন্দরবনে আর ১৪টি পশ্চিম বিভাগে মারা যায়। তবে আশার কথা হচ্ছে, এক মাস ধরে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বাচ্চাসহ বাঘিনীদের ঘুরতে দেখা যাচ্ছে।
বাঘসহ বন্যপ্রাণী রক্ষায় গোটা সুন্দরবন জুড়ে স্মার্ট প্যাট্রোলিং নামে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সার্বক্ষণিক পাহারা চলছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে কয়েক বছরের মধ্যেই বাঘের সংখ্যাও কয়েক গুণ বেড়ে যাবে বলেও জানান এই বন কর্মকর্তা।
এই বন কর্মকর্তা আরো বলেন, বাঘ রক্ষায় সরকার এরই মধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী হত্যায় সর্বোচ শাস্তি ১২ বছরের কারাদণ্ড ও বন্যপ্রাণীর আক্রমণে মানুষ নিহত হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক লাখ টাকা এবং আহত ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার বিধান করেছে।
মন্তব্য চালু নেই