হ্যালো ডিরেক্টর! আপনাকেই বলছি…

হল থেকে সিনেমা দেখে বের হলাম। সিনেমার নাম ‘লাভার নাম্বার ওয়ান’। মাথার মধ্যে দুটি বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। সব সিনেমার উপস্থাপনের ধরন কেন একইরকম হতে হবে? আর সবাইকে কেন সিনেমা নির্মাণ করতে হবে? গত এক বছরের মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হাতে গোনা দু একটা সিনেমা ছাড়া বাকিগুলোর আসলে কোনো সিনেমার চেহারা নেই। আমরা সবাই স্বীকার করি যে আমরা একটা খারাপ সময়ের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছি। তাই প্রচুর সিনেমা নির্মান হওয়া দরকার। কারন মার্কেট বড় করতে হবে। কিন্তু আসলেই কি তা হচ্ছে?

আমাদের সিনেমা পাড়ায় দু’টি বিষয় খুব লক্ষ্যনীয়। এফডিসির সিনেমা নির্মাতা, আর মিডিয়ার সিনেমা নির্মাতা। আসলে এই দু’টি ভাগের কতটুকু অস্তিত্ব আছে। আমাদের দেশে যেহেতু নির্মাতার জন্য কোনো একাডেমিক ব্যবস্থা নেই, তাই যে যেভাবে পারছে সেভাবে শুরুটা করছে। আলটিমেটলি জায়গাটা তো এক। কিন্তু আমরা নির্মাতারা পরস্পরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি কাজের প্রতিযেগিতায় নয়, ব্যক্তিগত আক্রমনের প্রতিযোগিতায়। তাতে কি হচ্ছে? সিনেমাটা ঠিকঠাক হচ্ছে না। যে কারনে চাইলেই যে কেউ ঘোষনা দিচ্ছে সিনেমা নির্মাণের, যে কেউ প্রযোজক হয়ে যাচ্ছে, নবাগত নায়ক নায়িকার অভাব হচ্ছে না। পত্রিকায় দম ফাটানো নিউজ হচ্ছে। সিনেমার শুটিং হচ্ছে। অধিকাংশ সিনেমা ঘোষনাতেই শেষ, কিছু সিনেমার কাজ অর্ধেক হয়ে আটকে থাকছে, কিছু সিনেমা শুটিং শেষ হয়ে আটকে যাচ্ছে। আর মুক্তির মিছিলে তাড়াহুড়ো করে প্রতি সপ্তাহে যা মুক্তি পাচ্ছে তা আসলে দ্বায়সারা কাজ।

আমাদের দেশের সিনেমার ক্ষেত্রে একটা কমন অভিযোগ আছে সেটা হলো কপি করা। আর একটা অভিযোগ যে সিনেমা হয় না, হয়ে যায় নাটক। এই দুটি বিষয়ই খুব আপত্তিকর। এই দুটি বিষয়ের পেছনে সবার আগে দ্বায়ভার নির্মাতার অস্থিরতা।

টেলিভিশন থেকে যার সিনেমাতে আসে তাদের মধ্যে মৌলিক গল্পের একটা চর্চা থাকে। তাই সিনেমা ভাবতে গেলে তাদের অধিকাংশ জনের মাথায় নানারকম বিষয় ঘুরপাক খায়। কেউ নিজের গল্পটি নির্মাণ করতে চায়। কেউবা গলা উঁচিয়ে বলে আমি একটা এফডিসির ছবি বানাবো।এই গলা উঁচিয়ে বলাটা একটা সমস্যা। আবার যারা দীর্ঘদিন ধরে সিনেমা নির্মাণ করছে কিংবা তাদের সঙ্গে কাজ করে যারা নতুন নির্মাতা হচ্ছে তাদের সবারই আলাদা বক্তব্য আছে। তাদের মাথায় কমার্শিয়াল বলে একটা টার্ম আছে। এবং এবং ফর্মুলার ছবি বলে একটা বিষয় আছে।

এই চলমান প্রক্রিয়ায় শুরু হয়ে যায় নির্মাতার দৌড়। দেখা যায় নতুন নির্মাতাগন তাদের স্বপ্নপূরনের জন্য এবং পুরানো নির্মাতাগন তাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা জাহির করে প্রযোজকের মুখোমুখি হন। প্রযোজকের চাহিদা, শখ কিংবা আল্লাদ পূরনের বিষয়টি মাথায় রেখে নির্মাতা তার নিজস্ব অবস্থান থেকে সরে আলোচনার মাধ্যমে সিনেমা নির্মাণের সিদ্ধান্তে উপনীত হন। আর তখনই শুরু হয়ে যায় স্বপ্নপূরণ অথবা অভিজ্ঞতার আলোকে সিনেমা দৌড়। ফর্মুলার গল্প, নির্মাতার গল্প, প্রয়োজকের গল্প, মার্কেটে যা চলে, দর্শকের গল্প, এফডিসির সিনেমার গল্প, কমার্শিয়াল গল্প এসব ক্যাটাগরি ভাবতে গিয়ে প্রথমেই নির্মাতা তার নিজের চিন্তার জায়গায় দ্বিতীয় ছুরি চালান করে।

সেক্ষেত্রে দেখা যায় টেলিভিশন ফিকশন থেকে আগত একজন নির্মাতা তার সিনেমার গল্পকে ফর্মুলায় ফেলতে গিয়ে গল্পটাকে ঠিকই গাছে উঠিয়ে দেয়। অন্যদিকে সিনিয়ার নির্মাতার পান্ডুলিপি রেডিমেট থাকেই। আর এফডিসি সিনেমার নির্মাতা দাবী করা নতুনেরা পার্শবতী অথবা হলিউডের কোনো ছবির গল্পে সরাসরি ছুরি চালিয়ে চিত্রনাট্য কেটে আনে। এর পরের বাকী টার্মগুলো একধরনের ঘোরের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে।

পরবর্তী বিহাইন্ড দ্যা সিনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় সিনেমা শেষ হতে না হতে নির্মাতার সঙ্গে তার প্রযোজকের একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। কারন প্রযোজকের শখ আর নির্মাতার স্বপ্ন মিলে একটা ককটেল হয়। সেটা শুভ কিছু হয় না। সিনেমা মুক্তির পর দেখা যায় মিডিয়া কাভারেজ সুপার হিট। কিন্তু প্রযোজকের থলিতে তেমন কিছু আসে না। যে কারনে একজন নতুন প্রযোজক হয় সিনেমার প্রতি খুব বিরক্ত হয়। অথবা এত বুঝে ফেলে যে নিজে নির্মাত হওয়ার সিদ্বান্তে যেতে চায়।

এই সময়ে মুক্তি প্রাপ্ত সিনেমার নির্মাতার বক্তব্য হয়- আমি বুঝতে পারি নাই,মার্কেট ভালো না অথবা আমি দর্শকের জন্য ছবি বানাইনি।

একজন নির্মাতা হিসেবে এই কথা গুলো আমার বলতে অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু এভাবে আর কতদিন পরিকল্পনাহীন কাজ হবে। একজন সিনেমার নির্মাতার উপর একটা ইন্ডাস্ট্রি এর ভালো মন্দ নির্ভর করে। সেখানে একজন নির্মাতার শুধু স্বপ্ন থাকবে অথবা নির্মাতা সাইনবোর্ড থাকবে? তার কোনো নিজস্ব অবস্থান থাকেবে না?

সিনেমার এই অসহায় অবস্থার জন্য সবার আগে দ্বায়ভার নিতে হবে নির্মাতা বড়ভাইদের। আমাদের পরিচালক সমিতি বলে একটা দোকান আছে। কিন্তু এই পরিচালক সমিতিতে বসে সিনিয়র নির্মাতা বড়ভাইদের দায়িত্ব কি শুধুমাত্র নতুন নির্মাতাদের সার্টিফিকেট দেওয়া?

আর এই সংকটের কারনে একজন নির্মাতা খুব সহজে মাথা নত করে দিচ্ছে তার সিনেমার জন্য। এটা একটা অপরাধ। নিজের কাজের আইডেন্টিটিকে ছোটো করে যা হয় তা আসলে আবর্জনা। আর আমরা সম্মিলিতভাবে এই সংকট তৈরি করে যাচ্ছি।

নির্মাতার নিজস্ব অবস্থানের সংকটের কারনে পরিকল্পনাহীন কাজ হচ্ছে। গল্প নির্বাচনে সমস্যা হচ্ছে। নির্মানে সমস্যা হচ্ছে। মার্কেটিং- প্রমোশন, হল ম্যানেজমেন্ট, এমনকি ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কিং একধরনের বড় সংকটের মধ্যে দিয়ে চলছে। আমি বিশ্বাস করি নির্মাতা সঠিক পরিকল্পনায় থাকলে তার প্রযোজক ব্যাবসায়িক পরিকল্পনা করতে বাধ্য। তখন সাইকেল অনুযায়ী প্রত্যেকটি জায়গার জট একটু একটু করে ঠিক হবে। আর প্লানমাফিক কাজ করতে চাইলে হয়তো একজন নির্মাতাকে তার সিনেমাটি করার জন্য বেশ একটা যুদ্ধ করতে হবে। সেখানে অনেকে টাকা লগ্নি করার বিষয়ে আগ্রহী হবে না। কিন্তু আলটিমেটলি ভালো কাজের মূল্যায়ন সবসময় থাকে। আর একজন নির্মাতাকে বছরে ৫/১০ টা সিনেমা কেন করতে হবে? সবার শেষে একটা কথা খুব জরুরী মনে করি- নির্মাতা আসলে সহজলভ্য হলে চলবে না। নানা শ্রেনী মানুষের চিন্তা চেতনা একজন নির্মাতাই এক ফর্মে আনতে পারে। তাই নির্মাতাকে তার নিজস্ব চাহিদার জায়গায় এলিট হতে হবে।

লেখক: তরুণ নির্মাতা



মন্তব্য চালু নেই