হিজড়ারা বেপরোয়া, অনেকেই আজ কোটিপতি
রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠছে কয়েকটি হিজড়া গ্রুপ। কয়েকটি এলাকায় নবজাতক ভূমিস্ট হলেই বাসায় মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় হিজড়ারা। পাশাপাশি চাঁদাবাজি, মারামারিসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে তারা। এমনকি তাদের হাতে খুনের ঘটনাও ঘটছে। আবার তারা সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। অনেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদকের কারবারও চালাচ্ছে। দিনের বেলায় চাঁদা ওঠানোর পাশাপাশি রাতে পতিতাবৃত্তির নামে ছিনতাইও করছে অনেকে। পাড়া-মহল্লায় আছে তাদের সোর্স। নবজাতক সন্তান জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে হিজড়ারা তথ্য পেয়ে যায় সহজেই। চাঁদা তোলে অনেকেই কোটিপতির বনে গেছেন। তাদের আছে ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে হিজড়াদের নানা অপকর্মের তথ্য।
তবে হিজড়াদের দাবি, তারা সমাজে অবহেলিত। তাদের কেউ সুনজরে দেখছে না। তাদের বাঁচার জন্য দেশে নেই কোনো নীতিমালা। সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। যার ফলে তারা চাঁদাবাজি করা ছাড়া কোনো বিকল্প পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
এদিকে, বাংলাদেশে কজন হিজড়া আছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে প্রায় ৫০ হাজারের মতো হিজড়া বসবাস করছে। তারমধ্যে শুধু ঢাকাতেই বসবাস করছে অন্তত ১৫ হাজার।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘হিজড়াদের ব্যাপারে অনেক অভিযোগ আসে তা সত্য। আমরা মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি না। তবে কেউ যদি ভয়ঙ্কর ধরনের অপরাধ করে তাহলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’
সর্বশেষ মঙ্গলবার উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরে চাঁদা তোলা নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের গুলিতে মানিক ওরফে সেঁজুতি (২৮) নামে এক হিজড়া আহত হয়েছেন। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেজুতির অভিযোগ- হিজড়া কচি, সীমা, স্বপ্না ওরফে খায়রুল ও শম্পা দুটি মোটরসাইকেলে এসে তাদের লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের এডিসি আব্দুস সালাম বলেন, ‘ওদের (হিজড়া) নিজেদের বিরোধের জের ধরে এ ঘটনা ঘটেছে।’
সূত্র জানায়, চাঁদাবাজি নিয়ে বিরোধের জের ধরে এর আগে খিলক্ষেত ও তুরাগের কামারপাড়া এলাকায় দুই দফায় গুলির ঘটনা ঘটেছে। একপক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। অনেক হিজড়ার কাছে অবৈধ অস্ত্রও আছে।
একাধিক ভুক্তভোগী জানায়, ঢাকার বনশ্রী, খিলগাঁও, মতিঝিল, উত্তরা, মোহাম্মপুর, আদাবর, গুলশান, বনানী, মহাখালী, ফকিরাপুল, আরামবাগ, লালবাগ, শান্তিনগর, মধুবাগ, মিরপুর, মধ্যবাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, রামপুরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে হিজড়ারা চাঁদাবাজি করে আসছে। আবার তাদের মধ্যে আছে ভুয়া হিজড়াও। এদের নেপথ্যে নিয়ন্ত্রণকারীদের অধিকাংশ ভুয়া।
২০০৯ সালের ২৫ আগস্ট দক্ষিণখান থানায় মখলেছ নামের এক হিজড়া আটজন হিজড়ার বিরুদ্ধে জিডি করেন। জিডি নম্বর ১২৯৬। ওই আটজন হলেন- রাহেলা, সোনিয়া, স্বপ্না, হায়দার, কচি, শারিকা, সোনালী ও আলো হিজড়া। বাদি মকলেছের বাড়ি ওই থানাধীন ফায়দাবাদ এলাকায়। জিডিতে উল্লেখ করে- ‘উল্লেখিত নামধারীরা আমাদের দিয়ে অন্যায়ভাবে জনগণের কাছ থেকে টাকা তোলার জন্য আমাদের হয়রানি করে থাকে। আমরা চাঁদা তুলতে না গেলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এ ছাড়া নানা অসামাজিক কাজ করতে বলে আমাদের। আমরা প্রাণনাশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’ ওই স্বপ্নার বিরুদ্ধেই মঙ্গলবার গুলি করার অভিযোগ উঠেছে।
এই স্বপ্নার বিরুদ্ধে পুরুষদের হিজরা বানানোরও আভিযোগ আছে। সুমি নামের এক ‘হিজড়া’ বলেন, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পূর্ব করাাইল এলাকার সুমন নামের এক কিশোর ছিলেন তিনি। রাজধানীর কাওরানবাজারে এসে অভাবে পড়ে হিজড়া দলে চলে যান। প্রায় বছর দশেক আগে স্বপ্না হিজড়া গ্রুপের সদস্যদের নজরে পড়েন তিনি। স্বপ্না তাকে দেখায়, হিজড়ারা তার চাইতেও কত বেশী টাকা আয় করছে। কত বিলাসী জীবনযাপন করছে তারা।
একপর্যায়ে স্বপ্না তাকে হিজড়া হওয়ার প্রস্তাব দেয়। তাই বেশি টাকা আয়ের আশায় অপারেশন করে পুরুষ থেকে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরিত হয় সুমন। নাম হয় সুমি হিজড়া। এরপর চাঁদাবাজি, মাদকব্যবসা, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ করতে হচ্ছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই জীবন আর ভালো লাগে না।’ পরিবারের সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই বলে জানান সুমন ওরফে সুমি হিজড়া।
সূত্র জানায়, হিজড়া তৈরি করে স্বপ্না নিয়ন্ত্রণ করছে চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা এবং ছিনতাইসহ নানা অপরাধ। তিনি সুমি ছাড়াও রবিউল থেকে চুমকি, শান্ত থেকে শান্তা কিংবা মাসুদ থেকে মাসুমাদের তৈরি করেছেন। এরা সবাই একটি বয়স পর্যন্ত ছেলে ছিলেন। তাদের একটি সংঘবদ্ধ চক্র নানান প্রলোভন দেখিয়ে অস্ত্রপ্রচার ও হরমোন ইনজেকশন পুশ করে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তর করে।
এদিকে ঢাকা জেলার ধামরাই এলাকার রোম আমেরিকান হাসপাতাল নামের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে প্রতিমাসে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানানো হচ্ছে বলে পুলিশ তথ্য পেয়েছে। তাছাড়া রাজধানীর শ্যামলী ও খুলনার ফুলতলার কয়েকটি ক্লিনিকেও লিঙ্গ কেটে হিজড়া করা হয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বপ্না হিজড়া বলেন, ‘জোর করে বা টাকা দিয়ে কাউকে হিজড়া বানানো যায় না। আমি যদি হিজড়া না হই তাহলে হিজড়ারা আমাকে কেন মানবে।’ স্বপ্নার দাবি, তার দলের ২৭ থেকে ৮০ জন রয়েছে। যারা প্রকৃত হিজড়া। ‘যারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে তারা নিজেরাই নানা অপরাধে জড়িত। পুলিশের কাছে খোঁজ নিলে আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যাবে না’, বলেন স্বপ্না।
সুমি, শান্তা, মাসুমা, চুমকি হিজড়া জানান, তারা নিজেদের মধ্যে সাংকেতিক ভাষায় কথা বলেন। যেসব ভাষায় কথা বলা হয় তার মধ্যে কয়েকটি হলো- চাম দেখ (গাড়ির ভেতরে ভালভাবে দেখ, কি-কি আছে)। ‘পান্তির কাছে কি থাপ্পু (টাকাসহ আর কি-কি আছে)? উত্তরে তারা বলে, আক্কা থাপ্পা (অনেক টাকা)। তখন জিজ্ঞেস করা হয়- কুনকুন (মোবাইল ফোন) আছে কিনা? ঝান্নিমাসি (সোনার চেইন), গিয়ানি মাসি (ল্যাপটপ) আছে কি না?
তারা আরো জানান, হিজড়া ছিনতাইকারীরা এসব সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালায়। সর্দার যখন তার শীষ্যদের ছিনতাই কাজে পাঠায় তখন মোবাইল ফোনে এভাবেই তাদের মধ্যে কথোপোকথন হয়। সুন্দরী নারী সেজে তারা যখন অপারেশনে নামেন তখন এমন সাংকেতিক ভাষায় কথা হয় সর্দারের সঙ্গে। নারী সাজিয়ে তাদেরকে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে টার্গেট করা ব্যক্তিদের নির্জন স্থানে নিয়ে সবকিছু কেড়ে নেয়া হয়। তাদের টার্গেট থাকে ধনাঢ্য পরিবারের উঠতি বয়সের যুবক অথবা ব্যবসায়ী অথবা মোটা বেতনে চাকরি করেন এমন লোকজন। কারণ এরা মানসম্মানের ভয়ে ছিনতাইয়ের শিকার হলেও তা প্রকাশ করেন না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, টঙ্গী শিল্পাঞ্চলে বর্তমানে প্রায় দুই শতাধিক হিজড়া বসবাস করছে। তাদের একাধিক গ্রুপ রয়েছে। তুরাগ, উওরা, উওরখান, দক্ষিণখান থানা এলাকায় আছে অন্তত ২০টি গ্রুপ। দক্ষিণখানের ফায়দাবাদ, কাঁঠালতলা, কোর্টবাড়ী, আজমপুর কাঁচাবাজার, কসাইবাড়ী, আশকোনা এলাকায় আছে ৪০টি গ্রুপ। একেকটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ১২ জন। গ্রুপগুলোর মধ্যে রাহেলা, স্বপ্না, কল্পনা হিজড়ার কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। রাহেলা হিজড়া থাকেন দক্ষিণখান। তার একটি পাঁচ তলা বাড়ি আছে। ওই বাড়িতে হিজড়ারা বসবাস করে।
তুরাগের কামারপাড়া, রাজাবাড়ী, ধউর, রানাভোলা, বাউনিয়া এলাকায় থাকে ১০টি গ্রুপ। তাদের গ্রুপ প্রধান হচ্ছেন কচি হিজড়া। সবাই তাকে গুরু মা বলে ডাকেন। বর্তমানে তিনি কোটিপতি বনে গেছেন। তার আছে দুটি বাড়ি।
মোহাম্মদপুর ও আদাবরে আছে ১২টি গ্রুপ। এ গ্রুপের প্রধান হচ্ছেন- সুইটি। আদাবরে তার নামে আছে একটি বাড়ি।
টঙ্গী এলাকার হিজড়া সর্দারনী কাকলী, আলাদী, কল্পনা হিজড়া জানান, আমরা কোনো অন্যায় অত্যাচার করি না। বাড়ি বাড়ি ঘুরে তুলা তুলে ও নাচগান করে টাকা উপার্জন করি। ছিনতাই ও মাদক ব্যবসার সাথে আমরা জড়িত নই। প্রকৃত হিঁজড়ারা কখনো চাঁদাবাজি করে না। এক শ্রেণির সুবিধাভোগী পুরুষ সহজ উপায়ে অধিক অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে ভারতে গিয়ে যৌনাঙ্গ অপারেশন করে হিজড়ার বেশ ধরে- তারাই চাঁদাবাজির ব্যাপারে বেপরোয়া। এদের সবার গ্রামের বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান রয়েছে।
খিলক্ষেত এলাকায় হিজড়াদের দল নেতা নাজমা হিজড়ার অধীনে রয়েছে ৪০ জন হিজড়া। ৩০ বছর আগে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজাড়া হয়েছে নাজমা। সে এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ পরিচিত। প্রায় অর্ধ কোটি টাকা বিভিন্ন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের কাছে তার সুদে দেয়া আছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে তার মাসিক আয় প্রায় দুই লাখ টাকা। ফায়দাবাদ, খিলক্ষেত ও গাজীপুর বোর্ডবাজার এলাকায় তার তিনটি বাড়ি ছাড়াও একাধিক প্লট রয়েছে। বটতলা ক১৮৩/৫নং মায়ের দোয়া নাজমা ভিলায় থাকেন নাজমা হিজড়া। এটি তার নিজের বাড়ি। খিলক্ষেত নামার বউরা এলাকায় আছে দু’টি প্লট।
ধলপুর এলাকার আবুল হিজড়ারও দুটি বাড়ি আছে। গোলাপবাগ এলাকার ১৩/বি/১ নম্বর নম্বর পাঁচ তলা ও ধলপুর লিচুবাগানে একটি চারতলা ভবনের মালিক তিনি।
উত্তরার মাসকট প্লাজার ব্যবসায়ী আবদুর রহমান ও রহিমউল্লাহ বলেন, হিজড়াদের অত্যাচারে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড চালাতে পারছি না। প্রশাসন উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে।
তবে হিজড়াদের নিয়ে গবেষণা করা সংগঠন বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সহকারী ব্যবস্থাপক মশিউর রহমান বললেন ভিন্ন কথা। তার মতে, হিজড়া একদিকে অবহেলিত আরেকদিকে বেপরোয়া তা সত্য। তারা যখন হিজড়া হয়ে যায় তখন তাদের পরিবারের সান্নিধ্য আর পায় না। ফলে তারা অন্য একটি জগতে চলে যায়। সেখানে তারা বাঁচার জন্য চেষ্টা করে।
তিনি আরো বলেন, সরকারের উচিত হিজড়াদের ব্যাপারে এগিয়ে আসা। সমাজের দশজনের সঙ্গে যেন তারা মিলেমিশে চলতে পারে সেই জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত। আবার যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এদিকে সরকার হিজড়াদের বেঁচে থাকার জন্য নানা উদ্যোগ নিলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কিছু হিজড়াকে ট্রাফিকের দায়িত্বে দেয়ার কথা থাকলেও তা কাগজকলমেই সীমাবদ্ধ। তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের লোক হিসেবে সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকই জাতীয় পরিচয়পত্রও পেয়েছেন। কিন্তু তাতেও তাদের বিশেষ কিছু হচ্ছে না।বাংলামেইল
মন্তব্য চালু নেই