‘গেটে-তালা’ দিলো না খালেদা জিয়াকে বেরুতে আর শেখ হাসিনাকে ঢুকতে!
হায়রে গেট!- হায়রে তালা! তোর কি ক্ষমতা!
বাংলাদেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ আর বিএনপি, এটা নিয়ে নিশ্চয়ই এরশাদও প্রশ্ন তুলবেন না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এক সময় এ দুই নেত্রীর মধ্যে ছিল বেজায় মিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা এক সঙ্গে বসে কথা বলেছেন, করেছেন হাস্যরসও। কিন্তু এখন সেটা ইতিহাসের পাতায়।
কারণ সর্বশেষ তাদের কথা হয়েছিল ২০০৯ সালের ৯ মে। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে ধানমণ্ডির সুধা সদনে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। সেখানেই কথা হয় দুই নেত্রীর। এরপর গত ২৬ অক্টোবর অবশ্য ফোনে তাদের কথা হয়েছিল। দেশের অস্থিতিশীল অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওইদিন সাবেক বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন। তাকে গণভবনে নৈশ্যভোজের আমন্ত্রণ জানান শেখ হাসিনা। যদিও তা প্রত্যাখ্যান করেন বেগম জিয়া। এর মধ্যেই হয়ে যায় জাতীয় নির্বাচন, বিএনপির বর্জন করা সেই নির্বাচনে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
একবছর পর ৫ জানুয়ারি, সোমবার দুপুর ১২টা। হঠাৎ করে কোনো এক গণমাধ্যম কর্মীর মুঠোফোন বেজে উঠলো। ভেতর থেকে আসা কলটি ধরতেই অপরপ্রান্ত থেকে বলা হলো, ম্যাডাম বের হচ্ছেন (গুলশানে নিজের কার্যালয় থেকে)। দ্রুত কল কেটে লাইভ টিভি ক্যামেরা অন করলেন ওই সংবাদকর্মী। সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে বসলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের ফটকের বাইরে অবস্থানরত অন্যসব গণমাধ্যমকর্মীরাও।
খালেদা জিয়া বের হচ্ছেন এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তেই মূল ফটকের কাটা অংশের সামনে দাঁড়িয়ে যান তিন নারী পুলিশ। কিন্তু তারা তাকিয়ে ছিলেন রাস্তার দিকে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে এক নারী পুলিশ রাস্তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকার পর দু’হাত পেছনে নিয়েই চেয়ারপারসন কার্যালয়ের মূল ফটকে দ্রুত একটি তালা লাগিয়ে দেন। ওইসময় তাকে আড়াল করে রাখেন পাশের দুই নারী পুলিশ সদস্য। অল্প সময়ের মধ্যেই আটকে দেয়া হয় পাশের পকেট দরজা ও উত্তর পাশের জরুরি ফটকটিও। এভাবেই তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়।
বাইরে থেকে প্রতিটি ফটক তালাবদ্ধ থাকা অবস্থাতেই ওইদিন বিকেলে ৩টা ৪৮ মিনিটে ওই ভবনের দোতলা থেকে নিচে নেমে আসেন খালেদা জিয়া। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসন রাস্তায় বের হওয়ার জন্য তার গাড়িতে ওঠেন। মূল ফটক বন্ধ থাকার কারণে গাড়িটি ১০ ফুটের মতো এগুনোর পর থেমে যায়। তখন বাইরে থাকা পুলিশকে মূল ফটক খুলে দিতে অনুরোধ করেন দলীয় নেতারা। কিন্তু পুলিশের সাফ জবাব, চেয়ারপারসনের নিরাপত্তার জন্যই তাকে বাইরে যেতে দেয়া ঠিক হবে না।
বিকেল ৪টার দিকে বিএনপির সাবেক এমপি সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া, রেহানা আক্তার রানুসহ অন্য নেতানেত্রী ‘জ্বালো জ্বালো’ স্লোগান দিয়ে ওই গেটটি ভাঙার চেষ্টা করেন। তখন বাইরে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা উত্তর পাশের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বিক্ষুব্ধদের ওপর পিপার স্প্রে ছোঁড়ে। এতে কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হন। তবে গাড়ির ভেতরে বসে থাকায় খালেদা জিয়া পিপার স্প্রে থেকে রক্ষা পান।
তিনদিন পর অবশ্য বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের মূল ফটকে লাগানো তালাটি খুলে ফেলা হয়। তবে মজার বিষয় হচ্ছে সেখানে দায়িত্ব পালন করা পুলিশ কর্মকর্তারা জানায়, গেটে কোনো তালা ছিল না। এর জবাবে গুলশান কার্যালয়ে খালেদার সঙ্গে অবস্থানরত তার প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান জানিয়েছিলেন, মূল ফটকে তালা ছিল কি ছিল না তা সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে দেশবাসী জানে।
খালেদার কার্যালয়ের মূল গেটে তালা ছিল কি ছিল না সেটা পুলিশ আর বিএনপি নেতারা জানেন। তবে এটা নিশ্চিত, গত ৩ জানুয়ারি থেকে খালেদার গুলশান কার্যালয়ের মূল গেটটি খোলা হয়নি। আর সেখান থেকে বের হননি খালেদা জিয়াও। সেখানে বসেই তিনি অবরোধ-হরতাল পালন করে যাচ্ছেন। এভাবেই চলছিল গত তিন সপ্তাহ। এর মধ্যেই শনিবার দুপুরে খবর আসে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত তার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো হৃদরোগে ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। ছেলে হারানো কষ্টে তিনি নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে একান্তে অশ্রুপাত করছেন। নিজেকে খানিকটা শক্ত করে পরে অবশ্য দরজা খুলে দেন। তাকে সমবেদনা জানায় দলের নেতারা।
এর মধ্যেই খবর আসে, ছেলের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে তার গুলশানের কার্যালয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে কার্যালয়ের আশেপাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এসএসএফ, পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়। সবাই তখন আসায় বুক বাঁধে। কারণ এক মৃত্যুই দুই নেত্রীকে একসঙ্গে করছে অনেক বছর পর।
অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই সাধারণ মানুষের সেই আসায় পানি ঢালেন বিএনপি চেয়পারসনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ছেলের শোকে অস্থির হয়ে পড়েছেন খালেদা জিয়া। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আমরা এখনো তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি নাই। তিনি (খালেদা জিয়া) সুস্থবোধ করলে এবং সাক্ষাৎ করার মতো পরিস্থিতি হলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সময় দেয়া হবে। তখন তিনি চাইলে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন।’
কিন্তু তার বক্তব্য শেষ হওয়ার কিছু সময়ের মধ্যেই খালেদার গুলশান কার্যালয়ে এসে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি গাড়ি থেকে নেমে কার্যালয়ের মূল গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। কিন্তু সেটি খোলা হয়নি। অবশ্য শোকে বিহ্বল খালেদা জিয়াকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে জানতে পেরে তিনি তার গাড়িবহর নিয়ে ফিরে যান। এসময় বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা অবশ্য হাতে তালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন। খালেদা জিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার দেখা হোক সেটা তারা কখনোই চাননি।
শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় প্রধানমন্ত্রী ফিরে যাওয়ার পর গুলশান কার্যালয়ের সামনে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। তিনি বিএনপি নেতাদের প্রতি অভিযোগ তুলে বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর সংবাদ শুনে প্রধানমন্ত্রী তাকে সাত্ত্বনা দেয়ার জন্য এখানে এসেছিলেন। তিনি একজন মা হিসেবে আরেকজন মায়ের কাছে এসেছিলেন। কোনো রাজনৈতিক কারণে তিনি আসেননি। তারপরও গেট না খোলা অমানবিক ও লজ্জাজনক।’
এখন শুধু এটাই বলতে হয়- হায়রে গেট!, হায়রে তালা! গত ৫ তারিখ থেকে তুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে বের হতে দিলি না, আর আজকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও ভেতরে ঢুকতে দিলি না। তোর কি ক্ষমতা! প্রধানমন্ত্রীও তোকে টপকাতে পারে না।
মন্তব্য চালু নেই