হারিয়ে যাচ্ছে একটি উপজেলা
একটি উপজেলা মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। উপজেলাটির নাম চৌহালী। এটি সিরাজগঞ্জ জেলায়। মানচিত্রের যে বিন্দুতে চৌহালী উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় প্রশাসনিক কার্যালয় চিহ্নিত করা আছে, বাস্তবে তা আর এখন নেই।
যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে চৌহালী উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সব অবকাঠামো। কর্মব্যস্ত মানুষের কোলাহলে দিনভর মুখর থাকা উপজেলা পরিষদ চত্বরের নিশানাও আজ আর নেই।
যমুনা নদী চৌহালী উপজেলাকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। নদীর পূর্ব পারে পাঁচটি ইউনিয়ন, পশ্চিম পারে দুটি ইউনিয়ন। গত দুই মাসে ভয়াবহ ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পূর্ব পারের পাঁচটি ইউনিয়ন। পূর্ব পারের খাসকাউলিয়া ইউনিয়নে ‘উপজেলা সদর’ নামে পরিচিত উপজেলা কমপ্লেক্সের পুরোটাই এ বছর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
গত আগস্ট মাসে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় এবং সর্বশেষ গত ৩ সেপ্টেম্বর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এরপর কার্যত প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় চৌহালী উপজেলার।
উপজেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় এবং দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে না পারায় চৌহালী নামটি সিরাজগঞ্জের মানচিত্র থেকে মুছে যেতে বসেছে।
তারা বলছেন, যেভাবে স্থলভাগ ভাঙছে, তাতে ক্ষতির হিসাবও ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। সকালে এক রকম তো বিকেলে আরেক রকম।
ইউএনও কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দেড় লাখ জনসংখ্যার চৌহালী উপজেলার আয়তন প্রায় ২৪৩ বর্গকিলোমিটার। গত কয়েক মাসের ভাঙনেই উপজেলার অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি কার্যালয় যমুনায় হারিয়ে গেছে।
এখন থানাসহ উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন দপ্তরের কার্যালয়ের কাজ চলছে চৌহালী ডিগ্রি কলেজের কয়েকটি কক্ষে। সেখানে পাশাপাশি দুটি কক্ষে ঠাঁই মিলেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার। জায়গা না হওয়ায় বারান্দায় বসে কাজ করতে হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সরিয়ে নেওয়া হয়েছে জোরপাড়া বাজার থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চৌহালী আলিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে কোনোরকমে চলছে চিকিৎসাসেবার কাজ।
চৌহালী থানার ওসি শামসুল ইসলাম জানান, এভাবে কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সমস্যা হচ্ছে। নিজেদের থাকার জায়গা নেই। যেখানে অফিস, সেখানেই থাকতে হচ্ছে। রাস্তাঘাট নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগের জন্য নৌকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কোনো আসামি ধরলেও তাকে রাখার কোনো জায়গা নেই।
চৌহালী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন জানান, সার্বিক পরিস্থিতি চিন্তা করেই সরকারের বিভিন্ন কার্যালয় কলেজে স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কলেজ প্রাঙ্গণের জন্য দুটি টিনের ঘর উপজেলা পরিষদ থেকে নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আপাতত পাঠদান চলছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের টাঙ্গাইল জেলার (চৌহালী উপজেলা এর আওতাধীন) নির্বাহী প্রকৌশলী জ্যোতি প্রকাশ ঘোষ জানান, যমুনা নদীর গতি-প্রকৃতি বোঝা খুব কঠিন। ভাঙন ঠেকাতে চেষ্টা করা হলেও তা রোধ করা যায়নি।
তিনি বলেন, দাতা সংস্থার অর্থায়নে এ বছরই যমুনা-মেঘনা মিটিগেশন প্রকল্পের আওতায় ভাঙন ঠেকাতে চৌহালী উপজেলায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যমুনার তীর সংরক্ষণে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হবে।
চৌহালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মাহমুদুল হক জানান, পুরো উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অবকাঠামো ভেঙে গেছে। বিভিন্ন সরকারি দপ্তর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে যেখানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, অব্যাহত ভাঙনের কারণে সেসব এলাকাও নিরাপদ নয়।
চৌহালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘উপজেলার রাস্তাঘাট, অবকাঠামো সবকিছু ভেঙে গেছে। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থা কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই বছরই উপজেলা পরিষদের ৮টি ভবন, ১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রায় দুই হাজার বাড়িঘর, হাজার হাজার হেক্টর আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। কার্যত এখন আমি পানির রাজ্যের চেয়ারম্যান হিসেবে খ্যাতি পেয়েছি।
মন্তব্য চালু নেই