হাজার মৃত্যুতেও প্রকৌশলীদের দুর্নীতি থামেনি
যাত্রীবাহী লঞ্চসহ বিভিন্ন ধরনের নৌযান দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ব্যাপক প্রাণহানি ঘটলেও দুর্ঘটনায় অভ্যন্তরীণ নৌখাতে অনিয়ম-দুর্নীতি চলছেই।
প্রতিটি দুর্ঘটনার পর ত্রুটিপূর্ণ ও নকশাবহির্ভুত নৌযান এবং অস্থায়ী নিবন্ধন ও টোকেনের মাধ্যমে সাময়িক চলাচলের অনুমতি প্রদানের অভিযোগটি সামনে এলেও এই অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর (ডস)।
তদন্ত কমিটির সুপারিশ এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও ডসের নির্দেশনা- কিছুই আমলে নিচ্ছে না নিবন্ধন ও ফিটনেস প্রদানকারী ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়াররা (প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক)।
ডিজি শিপিং হিসেবে পরিচিত ‘ডস’ এর প্রধান কার্যালয় এবং ঢাকা (সদরঘাট) ও বরিশাল কার্যালয় থেকে সম্প্রতি এ ধরনের বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে।
এছাড়া অনুসন্ধানকালে একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি নৌযানের অস্থায়ী নিবন্ধন দিয়ে তার ভিত্তিতে প্রতিবার ৪৫ দিন করে টানা পাঁচবার টোকেন দিয়ে সাময়িক চলাচলের সুযোগ এবং ১২ বছরের পুরনো একটি চোরাই নৌযানকে ‘নতুন নির্মিত’ দেখিয়ে নিবন্ধন ও ফিটনেস দেয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্যও উদঘাটিত হয়েছে। নৌ-নিরাপত্তাসহ জনস্বার্থে এসব ঘটনার প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী ও নৌমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি বছরের ৪ আগস্ট মাওয়ার পদ্মায় এমএল পিনাক-৬ লঞ্চ দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির পর দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হলেও ডিজি শিপিংয়ের ঢাকা কার্যালয় থেকে নকশা বহির্ভুতভাবে নির্মিত পাঁচটি যাত্রীবাহী নৌযানের অনুকূলে অস্থায়ী নিবন্ধন ও টোকেনের মাধ্যমে ৪৫ দিনের চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
এগুলো হচ্ছে- এমভি বন্ধন-৮ (এম-৭২৯৯), এমভি কাজল-৭ (এম-০১-১০৫৩), এমভি ফারহান-৫ (এম-৯৯৯৭), এমভি ফারহান-৬ ও এমভি সৈকত-১৪ (এম-৬৭৪২)। এর মধ্যে সৈকত-১৪ এর অনুকলে স্থায়ী নিবন্ধন ও বার্ষিক সার্ভে (ফিটনেস) সনদ জারির জন্য প্রধান কার্যালয়ে সুপারিশও করা হয়েছে।
তবে, অননুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মিত প্রথম চারটি নৌযানের অস্থায়ী নিবন্ধন ও টোকেনের মাধ্যমে চলাচলের অনুমতি দেয়ায় ডস মহাপরিচালক কমোডর জাকিউর রহমান ভুঁইয়া গত ২৬ অক্টোবর সংশ্লিষ্ট শিপ সার্ভেয়ার মো. মুঈনউদ্দিন জুলফিকারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন। এছাড়া এমভি সৈকত-১৪ এর ভেতরের কিছু অংশ নকশা বহির্ভুতভাবে পরিবর্তন করায় নৌযানটির ‘নকশা বহির্ভুত অংশ’ কেটে ফেলতে মালিককে পরামর্শ প্রদান এবং ততোদিন পর্যন্ত সার্ভে ঘোষণাপত্র জারি না করার জন্য ওই কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দিয়ে অফিস আদেশ জারি করেছেন মহাপরিচালক।
অস্থায়ী নিবন্ধন ও পাঁচবার টোকেন দিয়ে এক বছর চলাচলের সুযোগ
জানা গেছে, গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বরিশাল কার্যালয় থেকে ‘এমবি মারিয়া’ নামের একটি বালুবাহী নৌযান জরিপ দেখিয়ে পরের দিন ১৮ ডিসেম্বর এর অনুকূলে অস্থায়ী নিবন্ধন প্রদান ও একই দিন নৌযানটিকে ৪৫ দিন চলাচলের অনুমতি দিয়ে প্রথম দফায় টোকেন ইস্যু করা হয়। এর পর দ্বিতীয় দফায় টোকেনের মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি বছরের ১৭ মার্চ, তৃতীয় দফায় ৩০ এপ্রিল, চতুর্থ দফায় ১৪ জুন এবং পঞ্চম দফায় ২৭ আগস্ট পর্যন্ত নৌযানটিকে সাময়িক চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়।
আইএসও-৭৬ ও মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন
অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ (আইএসও)-১৯৭৬ ও এর অধীনে প্রণীত বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো নৌযানের অনুকূলে অস্থায়ী নিবন্ধন ও সাময়িক চলাচলের অনুমতি প্রদানের সুযোগ নেই।
কিন্তু বলা হয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডসের তীব্র জনবল সঙ্কটের কারণে আইএসও-১৯৭৬ এর সংশ্লিষ্ট বিধিমালা অনুসরণ করে ডস মহাপরিচালকের জারি করা অফিস আদেশে এই সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারকরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে বার্ষিক সার্ভে ঘোষণাপত্র জারি ছাড়াই বারবার টোকেন দিয়ে সব ধরনের নৌযান চলাচলের সুযোগ দিতে থাকেন। এরপর বিভিন্ন সময় নৌযান দুর্ঘটনায় গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটিগুলো তাদের একাধিক প্রতিবেদনে এই অনিয়ম বন্ধের জোরালো সুপারিশ করে। এরপর ডস মহাপরিচালক এক সার্কুলারে কোনো নৌযানের সাময়িক চলাচলের সময়সীমা সর্বোচ্চ ৪৫ দিন বেঁধে দিয়ে একাধিকবার টোকেন ইস্যু না করার আদেশ দেন।
পিনাক-৬ দুর্ঘটনার পর গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি ‘অস্থায়ী নিবন্ধন ও সাময়িক চলাচলের জন্য টোকেন ইস্যু’ প্রথা আইএসও-১৯৭৬ পরিপন্থী উল্লেখ করে তা বন্ধের জোরালো সুপারিশ করে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ওই প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর নৌ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে নৌ পরিবহনমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ডস, বিআইডব্লিউটিএ ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠকে দুর্ঘটনা রোধসহ নৌ-নিরাপত্তার স্বার্থে তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। অথচ মন্ত্রণালয় তথা সরকারের এই সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে নকশা বহির্ভুতভাবে নির্মিত পাঁচটি যাত্রীবাহী নৌযানের অস্থায়ী নিবন্ধন ও টেকেন ইস্যু করে চলাচলের সুযোগ দেয়া হয়েছে।
জাল কাগজপত্রে পুরনো-চোরাই নৌযানের নিবন্ধন ও ফিটনেস
জানা গেছে, গত জুলাইয়ে ড্রেজ বাংলা লিমিটেডের মালিকানাধীন বালুবাহী নৌযান ‘ড্রেজ বাংলা ৫৮’ (এম ১৬৫০৮) চুরির পর রাজধানীর ওয়ারী থানায় একটি মামলা হয়। সিআইডি পুলিশ মামলার তদন্তকালে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারপূর্বক জিজ্ঞাসাবাদের পর চোরাই নৌযানটি নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করে। ওই নৌযান থেকে জব্দকৃত কাগজপত্রে দেখা যায়, ‘ড্রেজ বাংলা ৫৮’ নৌযানটির নাম পরিবর্তন করে ‘নিউ স্বপ্নচূড়া’ নামে নতুন নিবন্ধন (এম ১৮৯২৪) ও সার্ভে করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে মুজিবুর জানান, ১২ বছর আগের পুরানা নৌযানটিতে রঙ করে নতুন নামে ও নতুন নির্মিত দেখিয়ে ২০১৩ সালে ডিজি শিপিংয়ের বরিশাল কার্যালয় থেকে নিবন্ধন ও বার্ষিক সার্ভে নেন তিনি।
আরো গেছে, নৌযানটির নিবন্ধন ও সার্ভে করানোর জন্য বরিশালের জাহাজ জরিপকারকের দপ্তরে আয়কর ও ভ্যাট সংক্রান্ত জাল কাগজপত্র জমা দেয়া হয়। এমনকি নৌযানটির নির্মাণস্থল ঢাকার কেরাণীগঞ্জের ‘আগরপুর ডকইয়ার্ড’ উল্লেখ করে দাখিল করা সেখানকার সনদপত্রটিও জাল বলে মুজিবুর স্বীকার করেছেন। অথচ প্রয়োজনীয় কাগপত্র যাচাই-বাছাই না করেই নৌযানটির নিবন্ধন ও সার্ভে সনদ জারি করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, নকশা বহির্ভুতভাবে নির্মিত নৌযানের অস্থায়ী নিবন্ধন ও টোকেন দিয়ে সাময়িক চলাচলের অনুমতি, অস্থায়ী নিবন্ধনের ভিত্তিতে একটি নৌযানের অনুকুলে টানা পাঁচবার টোকেন ইস্যু করে প্রায় এক বছর চলাচলের সুযোগ এবং জাল কাগজপত্রের ভিত্তিতে চোরাই ও পুরানা নৌযানকে নতুন হিসেবে স্থায়ী নিবন্ধন প্রদান ও বার্ষিক সার্ভে সনদ জারির মতো বেআইনি কর্মকান্ডের পেছনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অনৈতিক সুবিধা জড়িত রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কার্যালয়ের প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক মো. মুঈনউদ্দিন জুলফিকার বিভিন্ন নৌযানের অস্থায়ী নিবন্ধন ও টোকেনের মাধ্যমে সাময়িক চলাচলের অনুমতি প্রদানের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এটি প্রচলিত নিয়মে পরিণত হয়েছে।’
উল্লেখ্য, বেসরকারি হিসাবে, ১৯৭৭ সাথ থেকে ২০১৪ সালের মে পর্যন্ত ৩৭ বছরে ৪১৭টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। এপ্রিল-মে মাসেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।
মন্তব্য চালু নেই